ঝিনাইদহে ক্ষেতের অনাদরের আগাছায় আনছে টাকা
শিপলু জামান, ঝিনাইদহের চোখঃ
মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যতদুর চোখ যাচ্ছে মিলছে দিগন্ত জোড়া আমনের সবুজ ক্ষেত। এরই মাঝখানে কাশক্ষেত ফুলে ফুলে সাদা। মনে হচ্ছে শরতের সাদা মেঘের সাথে মিতালী করেছে।
শুধু এমন মনোরম সৌন্দর্য্য সৃষ্টিই নয় কৃষকদের লাভজনক মূল্যবান ফসল পানবরজের ছাউনিতে কাজে লাগানো হয় এই কাঁশগাছ। এ ফসল চাষে খরচ নেই বললেই চলে। চাহিদা বেশি ফলে দামও পাওয়া যায় ভালো। তাই ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বেশ কিছু কৃষক তাদের অনাবাদি ক্ষেতে কাঁশফুে লর চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, এ বছর উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামের মৃত গোলাম সরোয়ার বিশ্বাসের পুত্র আব্দুল হক, পাইকপাড়া গ্রামের সাখাওয়াত হোসেন, বারপাখিয়া গ্রামের আনোয়ার হোসেনসহ এলাকার অনেক কৃষক কাঁশফুলের বানিজ্যিকভাবে চাষ করেছেন।
কাঁশফুল চাষ করা কৃষকেরা জানান, এক সময়ে গ্রাম এলাকাতে মাটির দেয়ালের ঘর ছিল। এ ঘরগুলোতে ছাউনির জন্য খড় ব্যবহার করা হতো। কিন্ত সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এখনকার দিনে প্রায় সব বসতঘরই পর্যায়ক্রমে ইটের পাকা ঘর নির্মান হয়ে যাচ্ছে। এখানে ছাউনিতে ব্যবহার করা হচ্ছে টিন বা পাকা পাকা ছাদ। ফলে বসতঘরে এখনকার দিনে খড় লাগেনা। কিন্ত রেকর্ড পরিমানে বেড়ে গেছে পানচাষ। পানচাষীদের এ বরজে খড় ও কাঁশগাছ ব্যবহার হচ্ছে।
তারা আরও জানান, কোন কোন ফসলি জমিতে বিচ্ছিন্নভাবে আগাছা হিসেবে খড় ও ঝাটি গজিয়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে কৃষকেরা ফসলী ক্ষেতের আগাছা দমনের সময়ে সেগুলো কেটে ফেলে। কিন্ত কিছুদিন পর ফসলের মধ্যে আবার গজিয়ে ওঠে। অনেক জমিতে দমন করা সম্ভব হলেও শত চেষ্টা করেও কিছু কিছু জমিতে গজিয়ে উঠা ঝাঁটি ও খড় দমন করতে কৃষকেরা ব্যর্থ হন। কেননা এ কাঁশগাছের মূল চলে যায় মাটির গভিরে। তখন তারা বাধ্য হন ওই জমিটি ঝাঁটি বা কাঁশগাছের জন্য ফেলে রাখতে।
নিয়ামতপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল হক জানান, ফসলী ক্ষেতে জন্মানো এ অঞ্চলের ভাষায় ঝাটি গাছই হলো কাঁশগাছ। তিনি ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছেন ৫২ শতকের জমিটিতে অতীতে অন্য ফসলের চাষ করলেও তার মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ঝাটিগাছ দেখা যেতো। এ গাছের মূল চলে যেত মাটির গভীরে। বেশ কয়েকবার কোঁদাল দিয়ে গভীর করে খুঁড়ে মূল উঠিয়ে দিয়েছেন কিন্ত কিছু দিন পরেই আবার আগাছা হিসেবে দেখা দিত। এক পর্যায়ে দমনে ব্যর্থ হয়ে ক্ষেতটিতে অন্য ফসল চাষ বন্ধ করে দেন। তখন থেকেই জমিটিতে চাষ হচ্ছে ঝাটি বা কাঁশগাছের। যা প্রতিবছর বিক্রি করে বেশ পয়সা পাচ্ছেন। তিনি বলেন গত বছরও এ জমির ঝাটি ৪৫ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন।
পাইকপাড়া গ্রামের কৃষক সাখাওয়াত হোসেন জানান, এ চাষে তেমন কোন খরচ নেই বললেই চলে। বর্ষা মৌসুমে এ গাছের চারা গজিয়ে উঠলে গাছ শক্ত রাখতে সামান্য ফসফেটের সাথে কিছু পটাশ দিতে হয়। আর জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে তা দ্রæত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হয়। এরপর শীত মৌসুমে জমি থেকে কেটে ভাল করে শুকিয়ে রাখলে ক্ষেত থেকেই বরজ মালিকেরা কিনে নিয়ে যান। তিনি জানান, প্রায় ২৫ বছর ধরে এ জমিতে অন্য কোন ফসলের চাষ করা হয় না। জমিটি আলাদা ভাবে রেখে দেয়া হয়েছে কাশ ও খড়ের জন্য। তিনি বলেন, অন্য ফসল চাষ করলে উৎপাদন খরচ বাদে যে লাভ পাওয়া যেতো তার চেয়ে অনেক বেশি লাভ পাচ্ছেন তিনি। তিনি জানান, গত বছরও এ জমির কাঁশগাছ ও খড় বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। এ বছর আরো বেশি টাকা আসবে বলে তিনি আশা করছেন।
কাঁশফুল চাষী বারপাখিয়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন জানান, কাশ ক্ষেতে কাশগাছ ছাড়াও পাওয়া যায় চিকন জাতের খড় বা ছন। যে খড় ঘর ছাউনি ও বরজের পানের পট বাধার জন্য কাজে লাগে। এছাড়াও উভয় গাছই পানের বরজের ছাউনিতে ব্যবহার করা হয়। গ্রামাঞ্চালে এক সময়ে অনেক জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে থাকতো। এ পড়ে থাকা জমিগুলোতেই গজিয়ে উঠতো খড় বা কাঁশবন। এ খড়গুলো তখন কৃষকেরা নিজেদের পরিবারের বসতঘরসহ অন্যান্য ঘরের ছাউনিতে ব্যবহার করতেন।
পানচাষী উপজেলার বলরামপুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা জানান, পানের বরজে খড় ও কাশগাছের খুবই দরকার। আগে এ গাছ গ্রামাঞ্চালের ভিটে বা বন বাদাড়ে পাওয়া যেতো। এখন সব জমি আবাদি হয়ে গেছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, কৃষকদের ক্ষেতের ঝাটি এবং ঝাটির মাঝে গজিয়ে ওঠা খড় বা ছন বরজের পানের পট বাধতে ব্যবহার করে থাকে। কৃষকদের অনেক অনাবাদী জমিতে আজ কাঁশফুল ও খড়ের চাষ করে বরজ মালিকদের নিকট বিক্রি করে বেশ পয়সা পাচ্ছেন।