বুননে নতুন জীবণের হাতছানি কালীগঞ্জের অসহায় নারীদের
শাহরিয়ার আলম সোহাগ, ঝিনাইদহের চোখঃ
কেউ কাপড় কাটছেন, কেউ সেলাই করছেন।
অনেকে আবার সুই সুতোর বুননে নকশির ফোঁড় তুলছেন। আবার কেউ বাড়িতে তৈরি করা নানা নকশার নকশিকাঁথা, নকশি থ্রি-পিস, নানা রঙ-বেরঙের পুঁতি বসান শো-পিস কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিচ্ছেন।
আবার কেউ কেউ নতুন কাজের অর্ডার নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। একা হাতেই সব সামলাচ্ছেন সমিতির পরিচালক। তাকে সাহায্য করছেন কার্টিং মাস্টার।
ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের গৃহবধূ মিতা বিশ্বাস। তার তৈরি নকশিকাঁথা, থ্রি-পিস জমা দিয়ে নতুন অর্ডার নিতে এসেছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এ সমিতির আওতায় নকশিকাঁথাসহ বিভিন্ন নকশা করা পোশাক তৈরি করছেন। এর সদস্য হওয়ায় বছরজুড়েই কাজ করেন।
এ প্রসঙ্গে মিতা বিশ্বাস বলেন, প্রথম প্রথম নিজে অর্ডার নিয়ে বাড়িতে কাজ করতাম। কিন্তু আমার তৈরিকৃত পোশাক বিক্রি করতে অনেক সময় লেগে যেত। এখান থেকে অর্ডার নিয়ে সময়মতো কাজ দিই। বিক্রির ঝক্কিটা আমার নেই। সংস্থার পরিচালক দর কষাকষির মাধ্যমে কাজের অর্ডার দেয়। কাটিং মাস্টার নকশার ধরন বুঝিয়ে দেন। সেই মোতাবেক বাড়িতে বসে কাজ করি। সেলাই শেষ হলে জমা দিয়ে মজুরি নিই। আমার মতো অনেকেই জিনিসপত্রের অর্ডার নিয়ে বাড়িতে থেকে কাজ করেন।
এভাবে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের পৌর মহিলা সমবায় সমিতি প্রায় দুই শতাধিক অসহায় নারীর স্ব-কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ করছেন। বছর তিনেক আগে এলাকার দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থান তৈরিতে এ সমিতি গঠিত হয়।
সমিতির সদস্যভুক্ত একাধিক অসহায় নারী এ সম্পর্কে জানান, তাদের সবারই অভাব, টানাটানির সংসার। অনেকে নানাবিধ কারণে নিজেই সংসারের একমাত্র উপার্জন সক্ষম ব্যক্তি। অনেকের স্বামী সংসার থাকলেও সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়িতে অলস সময় না কাটিয়ে নকশিকাঁথা সেলাই, দর্জির কাজ, কুটির ও হস্তশিল্পের কাজ শিখছেন।
আবার কেউ কেউ অর্ডার মতো থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, নকশিকাঁথায় নানা ডিজাইনের কাজ করে সমিতিতে জমা দিয়ে ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন। এই উপার্জিত রোজগার দিয়েই চলছে তাদের সংসার।
হালকা কাজের একটি নকশিকাঁথা কমপক্ষে সাড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। শৌখিন এ কাঁথাগুলো পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য, আবার কখনও আপনজনকে উপহার দিতে স্থানীয়রাও অর্ডার দেয়। এছাড়া ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা শহরের ক্রেতারা নগদ টাকায় এসব পণ্যসামগ্রী কিনেন। সমিতিতে সামান্য টাকা জমা দিয়ে বাকি অর্থ কাজটিতে সংশ্লিষ্ট সদস্যরা পান।
এ গ্রামেরই আরেক সদস্য আলোমতি দাস জানান, কাঠমিস্ত্রি স্বামীর আয়ে সংসার চলে না। অনেক সময় কাজ থাকে না। অভাবের সংসারে দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছিল। বাড়িতে থেকে নিজে কাজ করে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। নকশিকাঁথার অর্ডার নিয়ে বাড়িতে সেলাই করে সময়মতো অর্ডার ফেরত দেয়ায় কিছু রোজগার করছেন। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে। তাদের লেখাপড়ার খরচ জোগানোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছেন।
তাদের মতো অনেকেই আগের থেকে নকশি কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতেন। কিন্তু তৈরিকৃত কাপড় বিক্রি করতে পারতেন না। একটি নকশি পোশাক বা কাঁথা সেলাই করতে অনেক সময় লাগে। সঠিক যোগাযোগের অভাবে এত কষ্টের কাঁথা বিক্রি করতে সময় লেগে যেত। এখন সবাই মিলে কাজ করার কারণে বাইরের অর্ডার বেশি পাচ্ছেন।
আবার অল্প সময়ের মধ্যে সেটা বিক্রিরও নিশ্চয়তা থাকছে। অভিজ্ঞ মাস্টার তাদের ডিজাইন বুঝিয়ে দেন। এ কারণে কাজগুলো নিখুঁত ও আকর্ষণীয়। নিজ এলাকার ক্রেতাদের পাশাপাশি বাইরের ক্রেতারাও এগুলো অধিক আগ্রহে কিনছেন। কাজ বেশি হওয়ায় এখন তাদের সারা বছরের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
কালীগঞ্জ পৌর মহিলা সমবায় সমিতির পরিচালক মিনা ভট্টাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেন, এখানে আমার নিজের কোনো অর্জন নেই। যারা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে নিখুঁতভাবে সূচিশিল্পের কাজগুলো করছেন তাদেরই অর্জন। একজন মহিলা মাস্টার সপ্তাহে একদিন তাদের বিভিন্ন হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দেন। তাদের মধ্যে অনেকে সুন্দর সুন্দর নকশি কাজে পারদর্শী।
তাদের তৈরিকৃত জিনিসগুলো বাইরের ক্রেতাদের আকর্ষণ করে। এসব পণ্য ন্যায্যমূল্যে তারা ক্রয় করেন। এ সমিতির কোনো ক্রেডিট প্রোগ্রাম নেই। প্রতি সপ্তাহে তাদের কাছ থেকে মাত্র ১০ টাকা করে নেয়া হয়। এ দিয়ে চলে সমিতির অন্যান্য ব্যয়। প্রশিক্ষকের বেতনও হয় এখান থেকে।
কালীগঞ্জের পৌর মহিলা সমবায় সমিতির প্রধান উপদেষ্টা মোচিক শ্রমিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুল জানান, এলাকার নারীদের নিয়ে গঠিত এ সমিতির সদস্যরা যারা আছেন তারা বেশির ভাগই হতদরিদ্র।
তাদের সংগঠিত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের দিয়েই কাজ করান হচ্ছে। তারা যাতে তাদের পণ্য ক্রেতার কাছ থেকে সঠিক দামে বিক্রি করতে পারেন এ যোগাযোগটাই করে দেয়া হচ্ছে। এ সমিতিতে কোনো ক্রেডিট প্রোগাম নেই। কিন্তু এক হিসেবে তাদের বিনা অর্থে সেলাইসহ হস্তশিল্পের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। যা দরিদ্র নারীদের উপার্জনের পথ খুলে দিয়েছে।