‘কেমন আছো ভাই’ বলার মানুষটি চলে গেলেন-আনিসুর রহমান
আনিসুর রহমান, ঝিনাইদহের চোখঃ
সূত্রঃ বিডি নিউজ২৪
কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন বিবিধ সুন্দর, মার্জিত রুচি ও বোধে শাণিত একজন মানুষ।
পোশাকে-ছুরতে অন্য সকলের থেকে আলাদা। পরে দিনে দিনে তা মডেলে পরিণত হয়েছে। দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেককেই দেখেছি রবিউল ভাইকে অনুকরণ করতে। আমাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে পোশাকের রুচি ও মার্জিত আবেদনে যারা আজও অনুকরণীয় ও অনসরণীয় হয়ে থাকেন এবং থাকবেন তাদের মধ্যে লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু অন্যতম। তেমনি রবিউল ভাই যে মডেল চালু করেছেন এটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে যাবে। আবহাওয়া বুঝে শীতকালে ফতুয়া বা শার্টের ওপর একটা ব্লেজার আর গলার মাফলার ঝুলানো ওড়নার মত করে। আর গরমকালে ফতুয়া বা তার নিজস্ব ধরনে বানানো শার্ট সঙ্গে মাফলার আদলের সুতির এক চিলতে কাপড় ঝুলানো।
একরকম বেশভূষার মানুষ রবিউল হুসাইনের নামটির সঙ্গে পরিচয় দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার সূত্রে। বৃহস্পতিবারের সংবাদ সাময়িকীতে অনেক সময়ই রবিউল হুসাইন নামের লেখকের গদ্য এবং পদ্য ছাপা হত। স্কুল কলেজে পড়ার বয়সের গ্রামের ছেলে আমি তখনও জানি না ব্যক্তি রবিউল হুসাইন একজন স্থপতিও। পরে ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন কবিতা উৎসবের সূত্রে রবিউল হুসাইন নামের মানুষটির সঙ্গে সরাসরি পরিচয়।
তখন জানলাম তিনি স্থপতিও। এই কবি ও স্থপতি ছোট বড় সকলের রবিউল ভাই। একমাত্র ব্যতিক্রম সম্বোধন করতেন কবি বেলাল চৌধুরী। তিনি খুব আন্তরিক টানে সম্বোধন করতেন, ‘রবি দা’ বলে। রবিউল ভাইয়ের সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধান তিন দশকের বেশি ছিল। কিন্তু পরিচয়ের শুরু থেকেই তিনি অনেকটা বন্ধুসুলভ স্নেহের হাত বাড়িয়েছিলেন। সে সাক্ষাৎ আর কথোপকথন আজও মনে পড়ে। এরপর থেকে কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন হয়ে গেলেন আমারও রবিউল ভাই। আর দেখা হলেই বলতেন ‘কেমন আছ ভাই’। ভাবতে খুব ভাল লাগে কবি পরিমণ্ডলের আমাদের চারজন কবি আমাকে এই দরদমাখা ডাকে কুশল জিজ্ঞেস করেন। অপর তিনজন হলেন রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী এবং হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
আমি দীর্ঘ কয়েক বছর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে যখন ঢাকার বিভিন্ন কাগজে কাজ করেছি বিশেষ করে বিচিত্রা, ইনডেপেনডেন্ট এবং নিউএজ-এ, তখন নানা সময়ে রবিউল ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হত। দেখাও হত গ্রীনরোডের তার স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে। তার বসার ঘরটি, চেয়ারটি, টেবিলটি, ঘরের চতুর্দিকে নানা জায়গায় ছবি, স্কেচ, পোস্টার এতোটা গোছালো-অগোছালোভাবে রাখতেন- যাকে ইংরেজিতে Delight in Disorder বলা যায়। আমার খুব ভাল লাগত, মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম এবং ঈর্ষাও করতাম এরকম একটা রুমের। রবিউল ভাইয়ের বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষার লেখার হাত ছিল চমৎকার। আমার অনুরোধে তিনি অনেক লেখা লিখে দিয়েছেন খুব কম সময়ের মধ্যে। সময়ানুবর্তিতা ছিল দারুণ। পরিছন্ন রুচিসম্পন্ন জীবনযাপন করতেন।
তিনি মুখে একটা বিরল সুন্দর হাসি মেখে রাখতেন। তার অফিসে অনেকবারই গিয়েছি। আমি উঠি বলি, উনি বলেন বসো, জরুরি কাজ না থাকলে গল্প করো। আরেক কাপ চা খাও। তার অফিসের দুধ চায়ের যে স্বাদ সারা ঢাকা শহরের কোনো বাসাবাড়ি বা দোকানের চা’য়ে এরকম স্বাদ পাইনি। জিজ্ঞেস করি করি করে আর করা হয়ে উঠেনি; এই চা কি তার বিশেষ পছন্দের আর ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করা ছিল? কী জানি এখন কে দেবেন এই প্রশ্নের উত্তর?
আমরা বয়োকনিষ্ঠ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ উভয়দিকের প্রায় সকলেই নিজেদের ঢোলটা নিজেরাই পেটাই। আলাপে আড্ডায় নিজেদের কাজ, লেখা নিয়েই কথা ছাড়ি। রবিউল ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। তাকে জিজ্ঞেস না করলে নিজে থেকে নিজের সম্পের্কে প্রায় কিছুই বলতেন না। অথচ দেখা হলে চোখ, মুখ ও কণ্ঠে আন্তরিক মনোযোগ মিশিয়ে জিজ্ঞেস করতেন- কেমন চলছে তোমার পড়াশোনা, লেখালেখির, কাজ? তারপর বিশেষ কোনো শহর বা দেশ, বা লেখকের প্রসঙ্গ আসলেই সব হড়হড় করে বলে যেতেন। তখন আমি অনেকটা মনোযোগী স্রোতা হয়ে যেতাম। মনে হত রবিউল ভাইকে কী বলব? উনি সাহিত্য, চিত্রকলা আর স্থাপত্য নিয়ে এত বেশি জানেন। তার কাছে সারাজীবন ছাত্র হয়ে থাকাই সৌভাগ্যের। একবার বছর কয়েক আগে ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে কবিতা উৎসবের সংবাদ সম্মেলনের আগে, দুজনে আলাপের এক পর্যায়ে প্রসঙ্গক্রমে টিএস এলিয়টকে উদ্বৃত করে বলেছিলাম- সাহিত্য বেনিয়াদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে সর্বনাশ। কথাটা তার মনে ধরেছিল। এর একটু পরেই সংবাদ সম্মেলনে কোনো এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে আমার কথা উল্লেখ করে উক্তিটি তিনি তুলে ধরলেন।
আমি তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাগত ছাত্র। রবিউল ভাইয়ের সহধর্মিনী ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি। বাঁচার আশা নাই বললেই চলে। রবিউল ভাই সেই কাঁচঘেরা ঘরের বাইরে রাতদিন দাঁড়িয়ে থাকতেন। তার শুভাকাঙ্ক্ষী লেখক বন্ধুরা আসতেন মাঝে মাঝে। আমিও সামাদ স্যারের সঙ্গে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। বেলাল ভাই প্রায় প্রতিদিনই আসতেন। সে যাত্রায় রবিউল ভাইয়ের সহধর্মিনী আমাদের সকলের ভাবী আর ফিরলেন না। এর কিছুদিন আগে রবিউল ভাইয়ের এক আত্মীয়ার স্বামী মারা গেলেন। এর সূত্র ধরে আমাদের এক বয়োজ্যেষ্ঠ কবি দুষ্টুমির সুরে বলেছিলেন, ন্যাচারাল সলৌশন (Natural Solution)। কথাটি মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। রবিউল ভাই নিভৃতচারী ছিমছাম এক মার্জিত সুন্দর জীবন যাপন করে গেলেন।
এরপর জনকণ্ঠে প্রকাশিত কবিতায় হিন্দু এক দেবীকে নিয়ে ব্যবহৃত একটি শব্দে হিন্দুসম্প্রদায়ের লোকজনের আপত্তি উঠে। তারা নাখোশ হন। রবিউল ভাইও বিষয়টি উপলদ্ধি করে বিব্রতবোধ করেছিলেন। হিন্দু বন্ধুরাও তাকে ভুল বুঝেছিলেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ এবং সেই সময়ে জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক দূর্গাদাশ ভট্টাচার্যের উদ্যোগে হিন্দু বন্ধুদের ক্ষোভের অবসান ঘটে। তিনি ছিলেন সর্বতোভাবে ধর্মনিরপেক্ষ একজন বাঙালি।
রবিউল ভাই ক্ষমতা ও অভিজাত্যের চরম শিখরে যেমন আরোহণের সুযোগ পেয়েছিলেন তেমনি একজন মানুষ, কবি বা স্থপতি হিসেবে নিজের মূলকেও ভুলে যাননি। বস্তির মানুষের জীবনের কষ্টবেদনার চিত্র ও গল্প যেমন তার জানা ছিল। তেমনি জানা ছিল দেশ-বিদেশের কোটিপতি মানুষের জীবনের নানা রঙিন কাহিনী। ক্ষমতার অনেক কাছে থেকেও সুযোগের মধ্যে বসেও তার অপব্যবহার করেননি। একটা বিষয় উল্লেখ করলেই পরিস্কার হবে, তার গ্রহণযোগ্যতা কত ঈর্ষণীয়। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন এর ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্য। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বাইরে দুই বা তিনজন সদস্যের রবিউল ভাই ছিলেন একজন।
রবিউল ভাইয়ের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সব পার্যায়ে। চরম দুঃসময়েও তার মধ্যে ভেঙ্গে পড়ার স্বভাব ছিল না। তার ব্যক্তিত্ব ছিল পিলারের মত সোজা, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন।
তিনি লেখালেখি, চিত্রকলা, স্থাপত্য, রুচিশীল আর সৃজনশীলতার বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে মনোযোগী ছিলেন বলে আমার কখনো মনে হয়নি। তার সামনে সুযোগ ছিল অবারিত। কিন্তু তিনি শয়নে-স্বপনে, নিদ্রায়-জাগরণে, ধ্যানে-জ্ঞানে ছিলেন একজন কবি ও স্থপতি। বাংলাদেশের কবিতা আর স্থাপত্যের ইতিহাসে এরকম সমন্বয় এর আগে কখনো ঘটেনি। তার জায়গাটা তারই। তার অবর্তমানে তা শূন্যই থেকে গেল। আর সেই ডাক শোনা হবে না, ‘কেমন আছ ভাই’? এমন ডাকের মানুষটি আমাদের ঢাকা শহরের সাহিত্য ও স্থাপত্য অঙ্গনের অলঙ্কার রবিউল ভাই। উপরওয়ালার দরবারে একটা অলঙ্কার যোগ হলো। আর আমরা যে কী হারালাম তা মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করব।
আরো একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে লেখাটি শেষ করব। রবিউল ভাই চমৎকার অনুবাদও করতেন। তিনি পাবলো নেরুদা এবং অ্যালেন গিনসবার্গের কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছেন। পাবলো নেরুদার এক বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু চিলির লেখক আকারিও কোতাপোসে। নেরুদা কোতাপোসের লোখালেখির দারুণ ভক্ত ছিলেন। কোতাপোসের মৃত্যুতে নেরুদা বলেছিলেন, আজ আমরা ছায়ার রাজত্বে যাকে নির্বাসিত করলাম, জীবিতাবস্থায় তিনি প্রতিদিন আমাদের একটি করে আকাশের তারা উপহার দিয়ে গেছেন।
আমাদের রবিউল ভাই ছিলেন রূপকথার মত, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকপার এক গ্রামের ছেলে, ঢাকা শহরে ‘আইডিয়া ফ্যাক্টরি’ তার ধারণাগুলোও আকাশের এক একটি তারার মত। রবিউল ভাইয়ের বিদায় বেলায় কল্পনা করি আহা পরপারে যদি তার সঙ্গে নেরুদার দেখা হয়ে যায়, কী কথা হতে পারে। শেষ যাত্রায়ও ভাল থাকুন রবিউল ভাই!
লেখক পরিচিতিঃ- আনিসুর রহমান পড়াশোনা করেছেন ঢাকা ও স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা সাহিত্য, ইতিহাস, চলচ্চিত্র, নাটক ও সুইডেনের দূরদর্শন সংস্কৃতি নিয়ে। তার গদ্য ও পদ্য অনূদিত আর সমাদৃত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। তার লেখা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে দেশে এবং বিদেশে।