প্রবাসী টাকায় পাল্টে গেল কালীগঞ্জের দামোদরপুরের আর্থ-সামাজিক অবস্থা
সাবজাল হোসেন, ঝিনাইদহের চোখঃ
অতীতে গ্রামটির অধিকাংশ মানুষই ছিল অস্বচ্ছল। সে সময়ে বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যদের দিন কেটেছে অনাহারে অর্ধাহারে। অল্প সংখ্যক ছাড়া বেশির ভাগ পরিবারগুলো বসবাস করতেন মাটির অথবা বেড়ার তৈরী ঝুঁপড়িঘরে। কিন্ত এখন আর সেই অবস্থা নেই। গ্রামের মধ্যে নির্মিত বড় বড় ইমারত পাল্টে দিয়েছে ওই গ্রামটির চিত্র। আর এটা সম্ভব হয়েছে গ্রামটি থেকে প্রায় ১ হাজার মানুষ প্রবাসে থেকে অর্থ পাঠানোর কারনে। তারা বিশ্ব শ্রমবাজারে শ্রম বিক্রি করে একদিকে নিজেদের ভাগ্যের উন্নতি ঘটিয়েছেন অন্যদিকে তাদের পাঠানো রেমিটেন্সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। একদিনের জ্বরাজীর্ণ গ্রামটির সবকিছুতেই আজ বিরাজ করছে শহুরে ছাপ। এমন আলোচিত গ্রামটি হলো ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের দামোদরপুর।
সরেজমিনে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সর্বশেষ প্রান্তের দামোদরপুর গ্রামটিতে গেলে দেখা যায়, রঙ বেরঙের বসতবাড়ি। বাড়িগুলো রঙ ও নকশায় শহরের বাড়িগুলোকে হার মানিয়েছে। গ্রামের সকল দিকেই উন্নত গ্রামীনযাত্রার যেন একেবারে শিখরে অবস্থান।
গ্রামবাসীরা জানান, আয়তন ও লোকসংখ্যার দিক দিয়ে তাদের গ্রামটির অবস্থান এ উপজেলার মধ্যে বড়। প্রবাসীদের সংখ্যার দিক দিয়েও গ্রামটির অবস্থান এ উপজেলার মধ্যে শীর্ষে এবং সারাদেশের মধ্যে অন্যতম। অথচ এক সময়ে এ গ্রামের মানুষ ছিল শুধুমাত্র কৃষি নির্ভর দিনমজুর শ্রেণীর। বেকারত্বের কারনে অভাব তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াতো। কিন্ত এখন আর সেই দিন নেই। কেননা গ্রামটির কর্মক্ষম মানুষের একটা বিরাট অংশ প্রবাসে গিয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর কারনে তাদের পরিবারগুলোর মাঝে ব্যাপক স্বচ্ছলতা ও সক্ষমতা এসেছে। গ্রামের লোকসংখ্যা অনেক বেশি হলেও অনেক মানুষ বিদেশে থাকার কারনে তারা ভোটারও হতে পারেননি। আবার বিদেশ থেকে ফিরে অনেকে আশপাশের গ্রাম ও শহরে গিয়ে সব আলিশান বাড়ি নির্মানের মাধ্যমে বসবাস করছেন। গ্রামবাসীদের দাবি গ্রামের সব মানুষ গ্রামটিতে ফিরলে মোট লোকসংখ্যা হবে প্রায় ছয় হাজারের অধিক।
তবে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিসংখ্যান ও নির্বাচন অফিস সূত্রে জানাগেছে, আজ থেকে ৯ বছর আগে গত ২০১১ সালের শুমারী অনুযায়ী দামোদরপুর গ্রামের মোট জনসংখ্যা ছিল তিন হাজার নয়শ ছিয়ানব্বই জন। এরমধ্যে পুরুষ এক হাজার নয়শ আটত্রিশ জন আর মহিলা দুই হাজার আটান্ন জন।
একই বছরের ভোটার তালিকা অনুযায়ী এ গ্রামের মোট ভোটার সংখ্যা দুই হাজার নয়শ তিতাল্লিশ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার এক হাজার চারশ একাশি জন। আর মহিলা ভোটার সংখ্যা এক হাজার চারশ বাষট্্ির জন।
ওই গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আলহাজ্ব আক্কাচ আলী জানান, গ্রামটি থেকে এবং এ উপজেলা থেকে তিনিই প্রথম ১৯৮০ সালে শ্রম বিক্রি করতে লিবিয়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে ২ বছর থাকার পর বেতন কম হওয়ায় ফিরে এসে ৬ মাস পরে ১৯৮২ সালের মাঝামাঝিতে সৌদি আরব যান। এ থেকেই শুরু। পরে গ্রামের মসলেম উদ্দীন, ইসমাইল হোসেনসহ আরও বেশ কয়েকজনকে তিনি নিয়ে যান। তারা এসে আবার স্বজনসহ গ্রামবাসীদের বিদেশে কাজের জন্য নেয়া শুরু করেন। এভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে প্রবাসীদের সংখ্যা। গ্রামের অনেকেই কর্মক্ষম যুবকদের প্রবাসে পাঠাতে কাজ করেছেন। তবে এ কাজে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন গ্রামের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম।
ওই গ্রাম থেকে সবচেয়ে বেশি দিন প্রবাসে জীবন কাটানো সুলতান আহম্মেদ জানান, তিনি ১৯৮৬ সালে মালেয়েশিয়াতে গিয়েছিলেন। এরপর কয়েকবার কিছু দিনের জন্য ছুটিতে এসে আবার চলে গেছেন। সর্বশেষ মাত্র ৩ মাস আগে একাধারে প্রায় ৩৪ বছর প্রবাসজীবন কাটিয়ে একেবারে চলে এসেছেন। তিনি আরও বলেন, প্রবাসে থেকে অর্থ পাঠিয়ে নিজের ভাই ভাইস্তেসহ গ্রামের অনেককে নিয়ে গেছেন।
সুলতান আহম্মেদের ভাষ্য, তাদের যৌথ পরিবারে মোট কর্মক্ষম পুরুষের সংখ্যা ছিল ১১ জন। তাদের মধ্যে এক সময়ে মোট ১০ জন ছিল প্রবাসে। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথম দিকে আপনজনদের ছেড়ে থাকতে খুব খারাপ লাগতো। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে বাড়ির সকলের কথা খুব মনে পড়তো। এখনকার দিনের মত যোগাযোগের মাধ্যম তেমন একটা ছিল না। ফলে সে সময়ে প্রবাসজীবন ছিল বেশ কঠিন। কিন্ত গ্রামের মানুষ বিদেশমুখী হওয়ায় প্রবাসে থেকেই ধীরে ধীরে আপনজন ও গ্রামবাসীদের অনেকের সাথে দেখা হয়েছে। অবস্থাটা এমন যতদিন গড়িয়েছে তাদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশে থেকে গ্রামবাসীদের সাথে দেখা হয়েছে অহরহ। তখন আর মনেই হয়নি প্রবাস জীবনের কষ্ট। এছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির কারনে যে কোন সময়ে পরিবারের সদস্যসহ দেশের সকলের সাথে যোগাযোগ করা সহজ হয়েছে। ফলে প্রবাস জীবনের আগের দিনের মত কষ্ট এখন আর অনুভূত হয় না।
ওই গ্রামের বাসিন্দা কোলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ডাঃ নুরুল ইসলাম জানান, তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন দেখেছেন কৃষিনির্ভর এ গ্রামটির অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অনেক দূর্বল। সে সময়ে বাড়ি বাড়িতে অভাব লেগে থাকতো। কিন্তু বর্তমানে তাদের গ্রামের প্রায় ১ হাজার মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন। এখন গ্রামের সব মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে। তিনি আরও জানান, তাদের গ্রামের মোট যে ভূখন্ড সে তুলনায় লোকসংখ্যা অনেক বেশি। তবে দীর্ঘ সময় প্রবাসে থেকে অর্থ রোজগার করে ফিরে এসে অনেক মানুষ পার্শ্ববর্তী শহর ও গ্রামে জমি কিনে আলিশান বাড়ি করেছেন। তিনি বলেন, যারা ২০ বছর আগে গ্রামটি দেখেছেন তারা এখন গ্রামের মধ্যে ঢুকে বড় বড় বাড়ি দেখে অবাক হন।
ওই গ্রামের আরেক সমাজসেবক হারুন অর রশিদ মোল্ল্যা জানান, তাদের গ্রামটি এ উপজেলার মধ্যে অন্যতম বড় গ্রাম। ছোটবেলায় গ্রামটির মানুষের অভাব তিনি দেখেছেন। সে সময়ে কিছু কৃষিনির্ভর পরিবার একটু ভালো পর্যায়ে থাকলেও বেশির ভাগ মানুষ ছিল দিনমজুর শ্রেণীর অস্বচ্ছল। তবে সেই গ্রামের চিত্র আজ পুরো পাল্টে গেছে। কেননা তাদের গ্রামের কর্মঠ যুবকেরা বিদেশে গিয়ে শ্রম বিক্রির মাধ্যমে অধিকাংশ পরিবার আজ অর্থনৈতিকভাকে ঘুরে দাড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন,এক সময়ের ঝুঁপড়ি ঘরের অধিক্যের গ্রামটির মধ্যে ঢুকে এখন রঙ বেরঙের বাড়ি দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, তাদের গ্রামের প্রবাসীরা শুধু নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটিয়েছেন তাই নয়। বৈদেশিক রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন তাদের গ্রামের প্রবাসীরা। তার ভাষ্য,এক গ্রাম থেকে এতো সংখ্যক মানুষ প্রবাসে থাকার বিষয়টি সারাদেশের মধ্যে আরও গ্রাম থাকতে পারে তবে একেবারে দৈন্যতা থেকে সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন না।
ওই গ্রামের বাসিন্দা ইউপি সদস্য জাফর ইকবাল জানান, তাদের গ্রামের মোট ভোটার সংখ্যা তিন হাজার দুইশত ত্রিশ। তাদের মধ্যে প্রায় বারো’শ কর্মক্ষম মানুষ রয়েছে প্রবাসে। জরিপ করে দেখা গেছে গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকেই দুই একজন করে মানুষ প্রবাসে আছেন। কোন কোন বাড়িতে প্রবাসীদের সংখ্যা আরও বেশি। তিনি আরও বলেন, লেখাপড়া বাদে যে সকল কর্মক্ষম যুবক আছেন তারাও চেষ্টা আছেন প্রবাসে যাওয়ার জন্য। গ্রামের সব মানুষই পরষ্পরে বন্ধু ভাবাপন্ন। তাই গ্রামের উন্নয়নে এবং সামাজিক কোন প্রতিষ্ঠান তৈরী অথবা কোন অনুষ্ঠান করতে গেলে বিদেশ থেকেই খরচের টাকা পাঠিয়ে দেন। ফলে অন্য গ্রামের চেয়ে তাদের গ্রাম খানিকটা ভিন্ন।
কোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন মোল্ল্যা জানান, তার ইউনিয়নের মধ্যে দামোদরপুর সবচেয়ে বড় গ্রাম। এক গ্রাম নিয়েই একটি ওয়ার্ড। এক সময়ে এ গ্রামের মানুষ খুব দরিদ্র ছিল। কিন্ত গ্রামটি থেকে অনেক মানুষ বিদেশে রয়েছেন। অনেকে দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে ব্যবসা বানিজ্য করছেন। আবার তাদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে। যে কারনে সারাদেশের মধ্যে এ গ্রামটি বেশ ব্যতিক্রমী বলে তিনি মনে করেন।
ঝিনাইদহ জেলা কর্মসংস্থান ও শ্রম অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সৌমিতা রানী মজুমদার জানান, জেলার মধ্যে কোন গ্রামের মানুষ শ্রমশক্তি রপ্তানীতে এগিয়ে এমন হিসাব তার কাছে নেই। তবে জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর গ্রামের বাড়ি বাড়ি থেকে অনেক কর্মক্ষম মানুষ প্রবাসে আছেন। তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় একদিকে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছেন অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছেন। তিনি আরও বলেন, প্রবাসে শ্রম বিক্রির মাধ্যমে একদিনের অভাবী গ্রামটি আজ উন্নত গ্রামে পরিণত হয়েছে। ফলে গ্রামটি নিসন্দেহে সারাদেশের মধ্যে ব্যতিক্রমী।