সমাজের আয়না ও নারী দিবস–তুহিন আফসারী
ঝিনাইদহের চোখঃ
সারা পৃথিবীতে সমতা ও মর্যাদার সমাজ প্রতিষ্টার জন্য নারী দিবস পালিত হয়ে গেলো। কিন্তু এই দিবস আমাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলছে তার একটা রিক্যাপ হওয়া দরকার। এই ময়নাতদন্তের যোগ্যতা আমার নেই। এটা বোদ্ধা ও চিন্তাবিদরা করবেন। আমি একজন উন্নয়ন কর্মী হিসেবে আমার শোনা কিছু ঘটনা সামনে নিয়ে আসতে চাই। আমি দেড় যুগের মতোন সময় ধরে উন্নয়ন কর্মী হিসেবে নারীদের সাথে কাজ করছি। বিভিন্ন প্রশিক্ষনে থাকার সুযোগ হয়েছে। এই সময়ে অধিকাংশ নারীই তাদের চোখের পানিতে নিজেদের গল্প শোনান। তারই কয়েকটি এখন সামনে নিয়ে আসতে চাই।
ঘটনা ১ঃ
দক্ষিণ অঞ্চলের কোন এক জেলার অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। তিনি শুরু করলেন।
তোমার প্রশিক্ষণে আসার দিনের ঘটনা। আমি বাসে আসবো। টার্মিনালে যাবার পর ড্রাইভার, সুপারভাইজার আমাকে সম্মানের সাথে সিটে বসিয়ে দেন। পাশের সিটটি ফাঁকায় ছিলো। আমি ওদের কথা চিন্তা করে কোন নারী অথবা অল্প বয়সী কাউকে বসাতে বললাম। গাড়ি ছাড়ার আগে এক কিশোরকে পাওয়া গেল। আমি তাকে পাশে বসিয়ে নিশ্চিত যাত্রা শুরু করলাম। একসময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ একটা অস্বস্তি নিয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমার মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার শরীরে অযাচিত স্পর্শ করছে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। পাশে নির্বিকার কিশোর শুয়ে আছে। কিশোর ছেলটার দিকে তাকিয়ে আমার নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হলো। নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলা আমি। ছি! একটা কিশোর ছেলে যে কিনা আমার নাতির চেয়েও ছোট তার সম্পর্কে ভুল ধারনা করছিলাম। আমার আর ঘুম আসলো না। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার একই অনুভূতি। আমি এবার স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার পাশের কিশোর আর কিশোর নেই সে পুরুষ হয়ে গেছে। তার হাত ই আমার শরীরে। লজ্বায় ঘৃনায় নিজেকে সামলাতে পারিনি। দিলাম এক থাপ্পড়। শব্দে সুপারভাইজার আসলো, আমি শুধু এইটুকু বলতে পারছিলাম যে, জানোয়ার টাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দাও। আমি সারা রাস্তা কেঁদেছি আর ভেবেছি কেন এইটা হলো। আমি আসলে ঐ কিশোরের কাছে কোন মানুষ ছিলাম না ছিলাম শুধু একজন নারী চাইলেই যার শরীরে হাত দেয়া যায় এবং গায়ে হাত দিতে কোন বয়স লাগেনা।
ঘটনা ২ঃ
উত্তর বঙ্গের একটা ট্রেনিংএ থাকা একজন নারী তার জীবনের একটা ঘটনা বললেন। ঘটনা ছিলোৃ
আমি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। শিক্ষকতা করি। আমার শশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি বেশ দূর। আমার বাবা মারা গেলেন। রাতে আমরা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলাম। ভোররাতে বাড়িতে পৌছালাম। আমার বাবার লাশ উঠানে। আমি ঘরে গেলাম। আমার স্বামীকে সময় দিলাম তারপর ওজু গোছল করে বাবার কাছে গেলাম। বাবার লাশ উঠোনে রেখেও আমি স্বামী সেবার হাত থেকে মাফ পাইনি সেদিন।
ঘটনা ৩ঃ
একজন কলেজের শিক্ষক যার বাবা তাকে দেখতে আসলে শাশুড়ী ও স্বামী অভিযোগ করতেন। নিভাঁজ নিপাট ভালো মানুষ বাবা শুধু মাথা নিচু করে শুনতেন। একসময় বাবা চলে যেতেন। যাবার সময় কলেজ শিক্ষক মেয়েটিও সাথে নামতেন এগিয়ে দেবার জন্য। এসময় কেউ কারো সাথে কথা বলতেন না, শুধু প্রতিটি সিড়িতে তাদের চোখের পানি পড়তো।
ঘটনা ৩ঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ করাচ্ছিলাম। অংশগ্রহণকারী হিসবে ছিলো ল ডিপার্টমেন্টের একজন যে তার ক্লাসে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া। তার বাবা তাঁকে একবছর পর্যন্ত দেখতে যাইনি শুধু মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারনে। বাবা এখন মেয়েকে নিয়ে অনেক গর্ব করে কিন্তু মেয়েটির যখন এইকথা মনে হয় তখন সে শুধুই কাঁদে।
ঘটনা ৪ঃ
একজন স্কুল শিক্ষক নারী ও তাঁর স্বামীকে সকল প্রকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে শুধু কন্যা সন্তান জন্ম দেবার কারনে। শুধু তাইনয় তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ঐ বাড়ির তিন পরুষ সদস্যের তিনটি ছেলে সন্তান আছে। শশুর শাশুড়ী কোন কন্যা সন্তানের জন্ম মেনে নিতে পারেননি। বাড়িতেও জায়গা হয়নি তাদের। এরকম হাজারো ঘটনার দেশ আমাদের। এখানে এখনো সিনেমা তৈরী হয় মেয়েরাও মানুষ, মা বড় না বউ বড়, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত নামে। এইদেশে এখনো ছয় মাসের শিশু থেকে শতবর্ষী বৃদ্ধা ধর্ষিত হয়। নুসরাত তনুদের মেরে ফেলা হয়।এইরকম একটা দেশে ঘটা করে নারী দিবস পালন একদিনের বাঙালি সাজার মতোন একটি ঘটনা। তাই দিবস পালন নয়, আমাদের মগজে যেদিন নারী মানুষ হিসেবে স্থান পাবে সেদিনই শুধু মাত্র একটি সমতার ও মর্যাদার সমাজ গড়ে উঠবে। কবে হবে সেটা? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।