পাঠকের কথা

সরকারি ত্রাণ বিতরণ সুষ্ঠু হোক–মাসুদ রানা, শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ঝিনাইদহের চোখঃ

নিজের ক্ষেতের সবজি নিয়ে এক কৃষক গেলেন বঙ্গবন্ধুর বাস ভবনে। বাড়ির কেয়ারটেকার মুহিত তাকে বসিয়ে সবজি গুলো নিয়ে গেলেন দোতলায়। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে কথা বলছিলেন। কথা বলা অবস্থায় কেয়ারটেকার মুহিত তাকে সবজির কথা বললেন।

বঙ্গবন্ধু পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ২০ টাকা বের করে দিলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় কেয়ারটেকার মুহিত ভাবলো সামান্য কিছু সবজির জন্য ২০ টাকা দেয়ার কী দরকার। সে ১০ টাকা রেখে দিয়ে বাকী ১০ টাকা দিলো কৃষকের হাতে। টাকা পেয়ে কৃষক অবাক হলো এবং দৌড়ে দোতলায় উঠে গেলো। ততোক্ষণে টেলিফোন রাখলেন বঙ্গবন্ধু ।
কৃষক বঙ্গবন্ধুর কাছে ১০ টাকা ফেরত দিয়ে বললেন, ” এ গুলো আমার ক্ষেতের সবজি, আমি আপনার জন্য এমনি এনেছি, টাকা লাগবেনা। “জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, ” কিন্তু আমি তো ২০ টাকা দিয়েছিলাম।” কৃষক জবাব দিলো, ” উনি তো আমাকে ১০ টাকা দিলো।

এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু বললো, ” যে দেশে দোতলা থেকে নিচতলায় পোঁছতে ২০ টাকা ১০ টাকা হয়ে যায় সে দেশে কত টাকার বাজেট প্রনয়ণ করলে তা জনগণের নিকট পোঁছবে ?”

বর্তমানে দেশে করোনাভাইরাসের প্রভাবের কারণে সরকার হতদরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ত্রাণ দিয়ে সহযোগিতা করছেন। ত্রাণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিচ্ছেন। কিন্তু সরকারের দোতলা থেকে নিচতলায় পৌঁছে সেটা আর নাই হয়ে যাচ্ছে। যাদের জন্য এই ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে তারাই বঞ্চিত রয়ে যাচ্ছেন।

এছাড়া সমাজের দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। আবার এই আর্থিক সংকটের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। এছাড়া সমাজে খেটে খাওয়া মানুষেরা ত্রাণ না পেয়ে বিক্ষোভ করেছে।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটা ঘটনা উল্লেখ করছি-
১. করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকটের মধ্যে অভাবে পড়ে ঝিনাইদহের মহেশপুরে উপজেলায় অহিদুল ইসলাম নামের এক ভ্যান চালক আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে। ৬ এপ্রিল দিবাগত রাতে উপজেলার কাজীরবেড় ইউনিয়নের ডালভাঙ্গা গ্রামে নিজ বাড়ির আড়ায় গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহতের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন জানান, তার স্বামী এনজিও ও বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে ৫৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। ভ্যান চালিয়ে যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালানো ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে রাস্তায় বের হতে না পেয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে তার আয়-রোজগার হচ্ছিল না। এ নিয়ে সংসারে অশান্তি চলছিল। সোমবার বিকেলে পাশের বাড়ি থেকে অল্প কিছু চাল ধার করে রান্না করে সন্তানদের খাওয়ান। কিন্তু তারা না খেয়ে ছিলেন।

সুফিয়া খাতুন অভিযোগ করেন, তারা কোনো সহায়তা পাননি। অভাবের কারণেই তার স্বামী আত্মহত্যা করেছেন।
২. সিরাজগঞ্জের বেলকুচি পৌর এলাকায় আফরোজা খাতুন নামে এক শিশু আত্মহত্যা করেছে। গলায় ফাঁস নিয়ে নিজ বাড়িতে সে আত্মহত্যা করে। স্বজনরা দাবি করেছেন, কয়েকদিন ধরে অনাহারে পরিবারটি। খাবারের জন্য কান্নাকাটি করায় পিতা থমক দেন আফরোজাকে। তারপরই ঘটে আত্মহত্যার ঘটনা।

বাবা আলম শেখ বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রশাসন কড়াকড়ি করছে। তাই দশদিন ধরে কাজ করতে পারছিনা। ঘরেই শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছি। হাতে নগদ টাকা নাই,তাই চালডাল কিনতে পারিনি। ঘরে খাবার নেই বলে মেয়ে কান্নাকাটি করছিল। আমি তাকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এরপর মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে।’

৩. বাড়িতে খাবার না থাকায় ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন লালমনিরহাটের কর্মহীন শতাধিক নিম্ন আয়ের মানুষ। ৮ এপ্রিল দুপুরে লালমনিরহাট জেলা শহরের হাড়িভাঙ্গা এলাকার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে এ বিক্ষোভ করেন তারা। লালমনিরহাট জেলার ৪৫টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভায় নিম্ন আয়ের ২২ হাজার ২৫০টি পরিবারের মাঝে সরকারিভাবে এ যাবৎ মোট ৩১৯ মেট্রিক টন চাল ও ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ এখনো ত্রাণ পাননি।

৪. যশোরে সরকারি ত্রাণ না পেয়ে দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বিক্ষোভ করেছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার এই সময়ে শত শত নারী-পুরুষ বসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন ত্রাণের দাবিতে। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ফটক বন্ধ করলে তারা কার্যালয় চত্বরে অবস্থান নেন।

৫. নাম তালিকাভুক্ত করার পরও ত্রাণ সহায়তা না পাওয়ায় বিক্ষোভ করেছেন রাজধানীর কুড়িল চৌরাস্তা এলাকার হতদরিদ্র মানুষ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর আবু ইসহাক মিয়ার কার্যালয়ে গিয়ে বিক্ষোভ করেন।
৬. সিলেট সদর উপজেলার ৩নং খাদিমনগর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের শতাধিক নারী-পুরুষ সরকারি ত্রাণের জন্য বিক্ষোভ করেছেন।

৭. চট্টগ্রামে ত্রাণ না পেয়ে বিক্ষোভ করেছে একদল দুস্থ মানুষ। তাঁদের অভিযোগ ত্রাণ দেওয়ার খবর দিয়ে এনে তাদের ত্রাণ দেওয়া হয়নি। এ কারণে তারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্দর থানার সামনে এ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এর আগে নগরীর খুলশী থানার জিইসির মোড় এলাকায় বাটা গলির সামনেও সড়ক অবরোধ করে ত্রাণের জন্য বিক্ষোভ করেন দুস্থ লোকজন।

৮. পঞ্চগড় শহরের নিরব-২ হোটেলের সামনে খাদ্য সামগ্রী না পাওয়ায় পেট দেখিয়ে বিক্ষোভ করে পঞ্চগড় হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যরা ।

৯. করোনা ভাইরাসের প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার দরিদ্র মানুষ। কোনো কাজ না থাকায় অনাহারে দিন কাটছে তাদের। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন এলাকাবাসী। বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রথমে থানার সামনে অবস্থান নেন তারা। পরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ফতুল্লার চৌধুরী বাড়িস্থ ফতুল্লা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফর রহমান স্বপনের বাড়ির সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন এলাকাবাসী।

১০. করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন শ্রমজীবী নারী-পুরুষ ত্রাণের দাবিতে গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের পশ্চিম পিয়ারাপুর ফাঁরাজ খাঁর বাজার এলাকায় মানববন্ধন করেছে। বোয়ালী-পিয়ারাপুর সড়কে এই কর্মসূচি পালিত হয়। এতে শতাধিক ঘরবন্দি দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ অংশ নেয়।

এদিকে ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেইঞ্জ প্রোগ্রাম পরিচালিত এক জরিপে দেখানো হয়েছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও ঘরে থাকার পরামর্শ মানতে গিয়ে নিম্নআয়ের মানুষের আয় অনেক কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে চরম দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে ৬০ শতাংশ। ১৪ শতাংশ (দুই কোটি ৩৮ লাখ) মানুষের ঘরে কোনো খাবারই নেই।

করোভাইরাসের সংক্রমণের ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মহীন লোকজনের তালিকা তৈরি করে তাদের খাদ্য সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। গত ২৯ মার্চ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামালের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিটি দেওয়া হয়।
এবিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান গণমাধ্যমে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টেলিফোনে এ নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশটি দেশের সব জেলা প্রশাসককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে সারা দেশে শহর ও গ্রামে কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন অবস্থায় আছে। এসব মানুষ অর্থাৎ ভিক্ষুক, ভবঘুরে, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানগাড়ি চালক, পরিবহনশ্রমিক, রেস্তোরাঁশ্রমিক, ফেরিওয়ালা, চায়ের দোকানদারের তালিকা তৈরি করে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কেউ যাতে বাদ না পড়ে এবং দ্বৈততা পরিহার করা যায়, সে জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য স্থানীয় পর্যায়ের বিত্তশালী ব্যক্তি, সংগঠন ও এনজিওগুলো খাদ্য সহায়তা দিলে জেলা প্রশাসকেরা সবার সঙ্গে সমন্বয় করে তালিকা তৈরি করবেন।
তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান।

নোটিশে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণের প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী এই মূহুর্তে আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষ, দিনমজুর, রিকশাচালক থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার লজ্জায় সাহায্য চাইতে পারছে না। এ সমস্ত পরিবারে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং ওষুধের অভাব কিংবা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন পত্র, পত্রিকা, টিভি মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে এ সংক্রান্ত নানা খবর প্রকাশ পেয়েছে। এই অবস্থায় সরকারের দায়িত্ব অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে তাদের নিকট খাদ্য ও ওষুধ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া।

এদিকে প্রতিদিন সারাদেশে ত্রানের চাল চুরির ঘটনা অহরহ হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা হতদরিদ্রদের চাল না দিয়ে নিজে গায়ের করে দিচ্ছেন। এতে ত্রানপ্রাপ্ত মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। যার ফলে ত্রান সুষ্ঠুভাবে বণ্টন না করে অসৎভাবে সেগুলো জনপ্রতিনিধিরা খেয়ে ফেলছে। সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ গুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বরং সরকার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। যার ফলে বিরোধী দল এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে সুযোগ নিচ্ছেন। তাই এই ত্রাণ যাতে প্রত্যেক হতদরিদ্র, নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরে পৌঁছে যায় সেই ব্যবস্থা সরকারকে গ্রহণ কর‍তে হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button