করোনাযুদ্ধে যেভাবে জয়ী ফাইজ নাফিয়া
ঝিনাইদহের চোখঃ
ডেকো গ্রুপে মার্চেন্ডাইজার পদে চাকরি করেন ফাইজ নাফিয়া রহমান। করোনাভাইরাস টেস্ট পজেটিভ হওয়ার পর তিনি কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি হন। ১০ দিন তিনি লড়াই করেন আনুবীক্ষণীক দানব করোনার বিরুদ্ধে। নাফিয়ার জীবনীশক্তির পিছু হটতে বাধ্য হয় প্রবল প্রতিপক্ষ কোভিট-১৯ নামের ভয়ঙ্কর ভাইরাসটি।
১০ দিনের িচিকিৎসা শেষে হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ফয়েজ নাফিয়া রহমান।। ফেসবুকে তিনি করোনা জয়ের গল্প, ১০ দিন হাসপাতালে থাকার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি এবং চিকিৎসক-নার্সদের সেবার কথা তুলে ধরেছেন।
নাফিয়ার সেই স্ট্যাটাসটি নিচে তুলে ধরা হলো, সহজবোধ্য করার জন্য তার স্ট্যাটাসের ইংরেজি শব্দগুলো কেবল বাংলা করা হয়েছে।
“ ৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় কোভিড-১৯ পজেটিভ রিপোর্ট আসার পর দ্বিধায় পরে গেছিলাম কোথায় থেকে চিকিৎসা নিব।আইইডিসিআর এর একজন ডাক্তার বলল আপনার যেহেতু তেমন কোন সিমটমস নেই তাই আপনি বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে পারেন। বাসায় বয়স্ক বাবা-মা আর ছোট ভাগ্নে থাকায় তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম হাসপাতালে সার্ভিস যতই খারাপ হোক হাসপাতাল এই যাব।আইইডিসিআরে আমার এ সিদ্ধান্তের কথা জানতেই ওরা আমাকে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের কন্ট্রোল রুমের নম্বর দিল.. কল দিলাম অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য.. রাত ১০.০০ টার দিকে অ্যাম্বলেন্সে করে রওনা দিলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। রাত ১১.৩০ এর দিকে পৌঁছলাম। আমাকে রুমে পাঠানোর আগেই এক ডাক্তার আমার সব ডিটেইলস নিয়ে নিল।
হাসপাতালে ছিলাম ১০ দিন। এই ১০ দিনে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ফেসবুক খুললেই অনেক কিছু দেখা যায়- যেমন : ছেলে করোনা সন্দেহে মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে গেছে আবার করোনা আক্রান্ত বাবার লাশ নিতে অস্বীকৃতি… এই রকম নিউজ এ যখন ফেসবুক এর নিউজফিড ভর্তি ঠিক তখনি এই হাসপাতালেআমার চোখের সামনে পৃথিবী তার অন্য রূপ মেলে ধরলো। সেই পৃথিবী ভালোবাসার। একে অপরের পাশে থাকার। তাইতো কোভিট-১৯পজেটিভ ওয়াইফ এর পাশে থাকার জন্য, সাহস যোগানোর জন্য সুস্থ হাজবেন্টও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। অসুস্থ মা- বাবাকে সেবা করার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেয়েও থেকে গেছে হাসপাতালে.. ২৪ ঘন্টা কোভিট-১৯আক্রান্ত প্রিয়জনেদের সেবা করে যাচ্ছে তারা। ” হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয় সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়”… কিন্তু যারা বইতে পারে তাদের জন্যই আছে উত্তম প্রতিদান। আর সেই প্রতিদান আসে পরম করুনাময় আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। আর তাই আল্লাহর অশেষ রহমতে আর মেহেরবানীতে আমি চলে আসার দিন পর্যন্ত এই মহান হৃদয়ের অধিকারী মানুষদের কোভিট-১৯ নেগেটিভ ছিল।এতো নেতিবাচক খবরের ভীরে এই রকম ভালোবাসা,বিশ্বাস আর সাহসিকতার গল্প গুলো অল্প হলেও নতুন করে বাঁচতে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
আরো এক কেস দেখলাম.. কোভিট-১৯শুধু জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট তেই থেমে নেই.. এটা আসে বিভিন্ন সিমটমস নিয়ে। আমি যখনআইইডিসিআরের কাছে জানালাম আমার তো জ্বর কাশি শ্বাসকষ্ট কিছুই নেই… যে গলা ব্যথা ছিল ঐটাও এন্টিবায়োটিক নেয়ার পর অনেকটাই কমে গেছে.. গত ১৯ দিন আমি আর আমার পরিবারের কেউ ঘরের বাহিরে যাই নি…! আমার কীভাবে পজেটিভ আসলো!! আমার প্রশ্নের উত্তরটা ছিল এই রকম যে- দেশের প্রায় ৮০% লোকের পজেটিভ আসবে যদি টেস্ট করানো হয় কিন্তু এদের কোন সিমটমস নেই.. ভাইরাস টা ওদের আক্রান্ত করে ঠিকই কিন্তু কিছু বোঝার আগেই রোগী ভালোও হয়ে যায়.. হাসপাতাল এও তার নমুনা দেখলাম কয়েকটা। পুরান ঢাকার দুইটা ফ্যামিলির সাথে পরিচয় হয়েছে..।
১। লোকটি হাসপাতালে ভর্তি হয় কোভিট-১৯পজেটিভ সব লক্ষণ নিয়ে.. পরিবারের অন্যান্যদের কেউ যখন টেস্ট করানো হলো তখন দেখা গেল উনার স্ত্রী ও এক ছেলের পজেটিভ কিন্তু বাকি দুই ছেলের নেগেটিভ. আর আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পজেটিভ স্ত্রী আর ছেলের কোন সিমটমস ছিল না আর এখন পর্যন্ত নেই। ওরা চাইলেই ঘরে বসেই চিকিৎসা নিতে পারতো কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে এতোটাই নিম্নমানের যে বাসার বাড়িওয়ালা ওদের বাসা থেকে বের করে দেয়াতে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছে। যাইহোক লোকটি এখন পুরোপুরি সুস্থ। আশা করি ২-৩ দিনের মধ্যে পুরো ফ্যামিলি রিলিজ পেয়ে যাবে।
২। আমার দেখা পুরান ঢাকার ২ নাম্বার ফ্যামিলির কথা বলি। এই আংকেল (বয়স আুমানিক ৬৫+) এর পজেটিভ ধরা পরে শুধুমাত্র ডায়রিয়াল সিমটমস নিয়ে. দুদিন পর উনার ওয়াইফ ভর্তি হলো করোনার সব সিমটমস নিয়ে। এর দুদিন পর উনাদের ছেলে ভর্তি হল শুধুমাত্র কাশি নিয়ে.. যদিও একইসাথে ছিল তারপরও ছেলের ওয়াইফ আর ওদের ছেলে-মেয়েদের নেগেটিভ ছিল। আমি আসার দিন দেখে আসছি আংকেল অনেকটাই সুস্থ আর আন্টিরও জ্বর চলে গেছে শুধু হালকা শ্বাসকষ্ট আছে.. ওইটাও চলে যাবে ইনশাআল্লাহ.. হতেই পারে পরের সপ্তাহে হয়তো এই ফ্যামিলি ও রিলিজ পেয়ে যাবে।
আরো একটা ঘটনা বলি যারা আইসিইউনিয়ে ভয়ে আছেন তাদের জন্য.. এক ভাইয়া করোনা পজেটিভ নিয়ে ভর্তি হয় ৫ এপ্রিল.. অবস্থা অনেক খারাপ থাকায় উনাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। উনার ভাষ্যমতে আইসিইউতে ২৪ ঘন্টা নার্স থাকে (এই তথ্য তাদের জন্য যারা ভাবেন নার্স রা শুধু ঘুমাইতেছে দেশের এই ক্রাইসিস মোমেন্টে)। যাই হোক উনি করোনার সাথে আইসিইউতে ৩ দিন লড়াই করে নরমাল ওয়ার্ডে চলে আসেন ৯ এপ্রিল। হয়তো গতকাল উনার রিলিজ হয়ে গেছে।
আমি হাসপাতালের যে ফ্লোরে ছিলাম সেখানে বেশিরভাগ এর অবস্থাই অনেক স্টেবল ছিল.. এই ১০ দিনে আমি মৃত্যু দেখেছি দুইজনের.. আল্লাহ যেন উনাদের সহ আরো যারা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সবাইকে কবরের আযাব মাফ করেন এবং বিনা হিসেবে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করেন.. সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থণা করি.. আমিন। এবার আসি ডাক্তারদের নিয়ে যাদের চুলকানি আছে.. এই ১০ দিনের এমন একটা দিনও ছিলো না যেদিন ডাক্তাররা ভিজিটে আসেননি। প্রতিদিন দুইবার করে রাউন্ড দিয়ে গেছেন.. রোগীদের সাহস দিয়ে গেছেন.. রোগীদের কথা শুনেছেন। সেই হিসেবে প্রয়োজনীয় অ্যাডভাইস দিয়েছেন.. যে রোগের কোনো ওষুধ এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নাই সেখানে আর কতোটুকুইবা করবে ডাক্তাররা! আমাকে রিলিজ দেয়ার আগের দিন এক ডাক্তার আমাদের বলেছিল ” আপনারা রিলিজ নিয়ে চলে যাবেন আর আমরা এখানে ভর্তি হব! কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের সব ডাক্তার – নার্সদের সবারই নমুনা নিয়ে গিয়েছিল আইইডিসিআর.. কারণ ওরা অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল.. ! তাই বলতেছি ডাক্তার নার্সদের সম্মান করতে না পারেন অন্তত গালি দিয়েন না.. একবার শুধু ভেবে দেখুন বর্তমান আক্রান্তের সংখ্যা এখনো দুই হাজারের মধ্যে আছে আর এখনি যদি সব ডাক্তার নার্স রা অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র,স্পেন, ইতালির মতো অবস্থা হলে কে আপনাকে চিকিৎসা দিবে? সৈনিক ছাড়া তো আর যুদ্ধ করা যায় না। আর এই করোনা যুদ্ধের আসল সৈনিক তো এরাই.. ডাক্তার.. নার্স..!
সবশেষে এই হাসপাতাল নিয়ে কিছু বলবো.. এই ১০দিন ৩ বেলা নিয়মিত খাবার-ঔষধ পেয়েছি…আগেই বলে রাখি ভাই এটা সরকারী হাসপাতাল তাই আইসোলেশন রুম এর কথা মাথাতেও আনবেন না, ভিট-সি সাপ্লিমেন্টারি দরকার হলে বাইরে থেকে কিনে হাসপাতালে ঢুকবেন …একদমই ভাবতে যাবেন না যে এইগুলো হাসপাতাল প্রোভাইড করবে! হাসপাতাল অনেক পরিস্কার কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে অনেক নোংরা.. তাই পরিস্কারের মর্ম আমরা বুঝি না.. এইখানে গিয়ে বুঝতে পারছি যে জাতি ‘হাগার’ করার পর ফ্ল্যাশ করতে পারেনা সেই জাতিকে আইসোলেশন আর কোয়ারেন্টিন বুঝাতে আরো ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। মাথায় রাখবেন সরকার হাসপাতালে এক ওয়ার্ডে ৬টা বেডের জন্য একটা টয়লেট। তাই নিজের নোংরা গুলো নিজে পরিস্কার করে ফেললে তো কোনো দোষের কিছু নেই.. অন্তত আমি দেখি না। ক্লিনারের জন্য ফেলে রাখার কী দরকার রে ভাই ! ওরাও তো মানুষ.. ওদেরোতো জানের ভয় আছে নাকি!!
যাদের আইইডিসিআর নিয়ে অনেক অভিযোগ ! আমি আইইডিসিআর থেকে অনেক সাপোর্ট পেয়েছি। আইডিসিআরের সহযোগিতাতেই এত তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে পেরেছি..নেক্সট উইকে আমার আরেকটা টেস্ট করাবে আর ঐটা নেগেটিভ আসলেই বন্ধ রুম থেকেও মুক্তি পাব.. সেই দিনের আশায় আছি ।
উপরের সবকিছুই আমি এই ১০ দিনে যা দেখেছি যা বুঝেছি যা অনুভব করেছি তার বহি:প্রকাশ মাত্র…সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত। সাবধানে থাকবেন.. যেহেতু এই রোগের কোনো ওষুধ নেই তাই একমাত্র উপায় হলো নিজের ইমিউন সিস্টেম বুস্ট আপ করা.. করোনাকে ভয় না পেয়ে ইমিউন সিস্টেমকে কাজে লাগান.. আর যদি এতটুকু লক্ষণ আপনার মধ্যে দেখা দেয় লুকোছাপা না করে প্লিজ টেস্ট করান.. চিকিৎসা নেন। আশা করি আল্লাহর দয়ায় ভালো হয়ে যাবেন.. আজাইরা কারনে সিমটমস লুকিয়ে আশেপাশের মানুষদের আর ডাক্তার দের সংক্রামিত কইরেন না। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন আর আশেপাশের সবাইকে ভালো রাখুন। নিজের ভালো থাকাটা যেমন জরুরী তেমনি আশেপাশের সবাইকে ভালো রাখাটাও আমাদের নৈতিক ও নাগরিক দায়িত্ব। আর সবসময় পরম করুনাময় আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন দেখবেন উনি ঠিকই আমাদের আলোর পথ, আশার পথ দেখাবেন।”