মুফতি সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)
ঝিনাইদহের চোখঃ
মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) একজন আনসারি সাহাবি। উপনাম আবু আবদুর রহমান। উপাধি ইমামুল ফুকাহা ও কানজুল ওলামা। হিজরিপূর্ব ১৮ সালে মদিনায় তার জন্ম। নবীজির হিজরতের আগে ‘আকাবা’র দ্বিতীয় বাইয়াতে অংশগ্রহণকারী ৭০ জনের তিনি একজন। সেখানে মুসলমান হয়ে মদিনায় ফিরে যান। তখন তিনি ১৮ বছরের যুবক। হিজরতের পর নবী (সা.) তার সঙ্গে আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) কে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন।
জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) বলেছেন, ‘তিনি দেখতে অনেক সুন্দর ছিলেন। ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী, সত্যবাদী ও দানশীল। অনেক সময় দান করতে করতে ঋণী হয়ে পড়তেন। এ বিষয়ে নবী (সা.) এর কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ পর্যন্ত গেছে।’ সব যুদ্ধে তিনি নবী (সা.) এর সঙ্গে ছিলেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, কোরআনের হাফেজ, আলেম ও মুফতি। নবী (সা.) এর জীবদ্দশায় তিনি ফতোয়া দিতেন। এজন্য মক্কা বিজয়ের পর তাকে সেখানকার লোকদের শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা চারজনের কাছে কোরআন শেখ : আবদুল্লাহ বিন মাসউদ, আবু হোজায়ফার গোলাম সালেম, মুয়াজ বিন জাবাল ও উবাই বিন কাব (রা.)।’ (বোখারি : ৪৯৯৯)।
মুজাহিদ (রহ.) বলেন, মক্কা বিজয়ের পর সেখানকার মুসলমানদের কোরআন ও ইলমে ফিকাহ শিক্ষাদানের জন্য মুয়াজ (রা.) কে দায়িত্ব দিয়েছিলেন নবীজি (সা.)। খলিফা ওমর বিন খাত্তাবের শাসনামলে এক ব্যক্তি নিজ স্ত্রী থেকে দুই বছর পর্যন্ত দূরে ছিল। সে ফিরে এসে দেখল স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী গিয়ে খলিফার কাছে বিচার চাইল। খলিফা তাকে পাথর মেরে হত্যার নির্দেশ দিলেন। মুয়াজ বললেন, হে আমিরুল মুমিনিন, আপনি এই নারীকে হয়তো হত্যা করতে পারেন, কিন্তু তার পেটের বাচ্চাকে হত্যা করার অধিকার আপনার নেই। এতে খলিফা তাকে হত্যার রায় প্রত্যাহার করে নেন। ওই নারী কিছুদিন পর দুই দাঁতওয়ালা বাচ্চা প্রসব করল। মহিলার স্বামী তাকে অবিকল নিজের মতো দেখে বলল, এটা আমারই সন্তান। খলিফা তা জানতে পেরে বললেন, ‘সেদিন মুয়াজ উপস্থিত না থাকলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত।’
মুয়াজ (রা.) একদিন মসজিদে এসে দেখলেন, নবীজি সেজদায় গেছেন। তা দেখে তিনিও সরাসরি সেজদায় গেলেন। নামাজের পর এক ব্যক্তি তাঁকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ‘নবীজির সঙ্গে তালমিলিয়ে চলা পছন্দ করি’। দয়ার নবী তা জানতে পেরে খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘এখন থেকে এমন করা তোমাদের জন্য সুন্নত করে দিলাম।’ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, ‘মুয়াজ একাই একটি একনিষ্ঠ জাতির সমতুল্য, যেমন ছিলেন নবী ইবরাহিম (আ.)।’
নবী (সা.) মুয়াজ (রা.) কে ইয়েমেনের গভর্নর করে পাঠানোর সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছিলেন। তখন মুয়াজ ছিলেন উটের পিঠে বসা। নবীজি পায়ে হেঁটে তাঁকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রিয়নবী জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো মামলা-মোকদ্দমা এলে কিসের ভিত্তিতে ফয়সালা করবে হে মুয়াজ? তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহ তায়ালার কিতাব দিয়ে ফয়সালা করব। আল্লাহর কিতাবে তা না পেলে কী করবে?
তাহলে আল্লাহর রাসুলের সুন্নত দিয়ে ফয়সালা করব। তা কোনো সুন্নতের ভেতর না পেলে কী করবে? চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব। এতে কোনোরূপ ত্রুটি করব না। এই জবাব শুনে প্রিয়নবী (সা.) খুশি হয়ে তার বুকে হাত রেখে সাবাস দিয়ে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, তিনি তাঁর রাসুলের দূতকে ঐকমত্য এনে দিয়েছেন।’ (তিরমিজি : ১৩২৭)।
নবীজি বললেন, আগামী বছর হয়তো আমাকে আর দেখতে পাবে না। তবে আমার মসজিদ ও কবর দেখতে পাবে। তাঁর বিচ্ছেদের কথা শুনে মুয়াজ বিন জাবাল জারজার হয়ে কান্না করতে লাগলেন। নবীজি তাকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন, কেঁদো না, হে মুয়াজ। কান্না তো শয়তানের উসকানিতে হয়ে থাকে। বিদায়বেলা তাকে দোয়া দিলেন, ‘আল্লাহ যেন তোমাকে সামনে-পেছনে থেকে হেফাজত করেন। মানুষ ও জিনের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করেন।
একদিন নবী (সা.) তাকে বলেছিলেন, হে মুয়াজ, তোমাকে আল্লাহর জন্যে ভালোবাসি। মুয়াজ বললেন, আমিও আপনাকে আল্লাহর জন্যে ভালোবাসি। নবীজি বললেন, তুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর এই দোয়াটা পড়তে ভুলবে না : ‘রাব্বি আইন্নি আলা জিকরিকা, ওয়া শুকরিকা, ওয়া হুসনি ইবাদাতিকা’। হে আল্লাহ, আপনার জিকির, শুকরিয়া ও উত্তম ইবাদতে আপনি আমাকে সাহায্য করুন।
তাহাজ্জুদের সময় তিনি কেঁদে কেঁদে বলতেন, ‘হে আল্লাহ, এখন সবার চোখ ঘুমিয়ে পড়েছে। সব নক্ষত্র অস্তমিত হয়েছে। আর আপনি হচ্ছেন চিরঞ্জীব। আপনার কাছে আমার জান্নাত প্রার্থনার গতি বড় মন্থর। জাহান্নাম থেকে বাঁচার কাকুতিও দুর্বল। আমার হেদায়েতের জন্য একটা আলোকবর্তিকা বানিয়ে রাখুন; কিয়ামতের দিন সেটা আমাকে দেবেন। আপনি কখনও অঙ্গীকারের বরখেলাপ করেন না।’ (তাবারানি : ১৬৪৭৮)।
ওমর (রা.) এর খেলাফতকালে সিরিয়া বিজয়ের সময় ১৮ হিজরিতে ফিলিস্তিনের আমাওয়াস শহরে এক মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে আক্রান্ত হয়ে মুয়াজ, তার দুই স্ত্রী ও এক ছেলেসহ ২৫ থেকে ৩০ হাজার মুসলমান ইন্তেকাল করেন।
মৃত্যুশয্যায় বারবার বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিলেন। চেতনা ফিরে পেলেই বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনার সামনে দাঁড়ানোর চিন্তা আমাকে পেরেশান করে তুলেছে। আপনার সম্মানের কসম করে বলছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি। এখন আপনার ইচ্ছামতো আমাকে শ্বাসরোধ করুন।’
সকালবেলা মৃত্যুকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘মারহাবা, হে আমার মৃত্যু।’ প্রভুকে ডাকলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি জানেন, এতদিন আমি আপনাকে ভয় করে জীবন কাটিয়েছি। আজ আপনার কাছে রহমতের আশা করছি। পৃথিবীর সাগর-নদী প্রবাহিত করা বা গাছগাছালি রোপণ করার জন্য আমার বাঁচা উদ্দেশ্য ছিল না। বরং আমার মনোবাঞ্ছা ছিল শুধু কোনো রকমে জীবনযাপন, গ্রীষ্মের খরতাপে রোজা রেখে প্রবল পিপাসার মজা অনুধাবন, কালের দুর্যোগে ধৈর্যধারণের স্বাদ উপভোগ এবং আলেম-ওলামার বিভিন্ন মজলিসে গমন।’
মৃত্যুর পূর্বক্ষণে তিনি প্রচুর কাঁদছিলেন। জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি কেন কাঁদছেন, আপনি তো রাসুলের সাহাবি? আপনিই বনি সালামার মূর্তি ভেঙে দিয়েছিলেন। আপনার সম্পর্কে নবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মুয়াজ থাকবে ওলামা কেরামের নেতৃত্বে এক-দুই ধাপ এগিয়ে।’ এর মানে আপনি জান্নাতে যাবেন। আপনি এমন…, এমন…।
তিনি জবাব দিলেন, মৃত্যু এসে পড়েছে বা দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে, এই ভয়ে আমি কাঁদছি না। আমার ভয়, সেখানে তো দুটি দল, জান্নাতি ও জাহান্নামি; আমি কোন দলের অন্তর্ভুক্ত তা জানি না।’ আল্লাহর রহমতের আশা নিয়ে এভাবে অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১/৩৯২, উসদুল গাবা : ৫/১৮৭, ইবনে সাদ : ৩/৫৮৩)।