প্রাণীর প্রতি নবীজির মমতা
ঝিনাইদহের চোখঃ
‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)।
শুধু মানুষ নয়, সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রতি রাসুলের ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। কারণ তিনি হলেন রহমাতুল্লিল আলামিন। পশু-পাখি প্রকৃতির অন্যতম উপাদান, এদের প্রতি ভালোবাসা রাখা এবং অধিকার রক্ষা করা নবীজির শিক্ষা। মহানবী মানুষকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন পশুপাখি। ভালোবাসতেন তরুলতা ও প্রকৃতি। কেবল মানবজাতি নয়, জীবজন্তুর অধিকার রক্ষায়ও তিনি ছিলেন সোচ্চার।
জাহেলিয়াতের যুগে পশু-পাখির সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করা হতো। তারা জীবজন্তদের নিশানা বানিয়ে হত্যা করত। ঠিকমতো খাবার দিত না। সুস্থতার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করত না। জন্তুর ওপর অতিমাত্রায় বোঝা চাপিয়ে দিত। পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হতো না। সারাদিন নির্দয়ভাবে খাটাত। নির্মমভাবে শাস্তি দিত এবং যেভাবে ইচ্ছা যত্রতত্র ব্যবহার করত। রাসুল (সা.) এসব জঘন্যতম প্রথা দূর করেন। তিনি জীবজন্তু ও পশু-পাখির দুঃখে ব্যথিত হতেন। তাদের কষ্টে বিচলিত হতেন।
একদিনের ঘটনা। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক আনসারির খেজুর বাগানে প্রবেশ করলে হঠাৎ একটি উট তাঁর চোখে পড়ে। উটটি তাঁকে দেখে কাঁদতে লাগলো। নবীজি অনেক ব্যথিত হলেন। তিনি উটটির কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। এতে উটটির কান্না বন্ধ হয়ে গেল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ উটের মালিক কে? এক আনসারি যুবক এসে বললো, হে আল্লাহর রাসুল, আমি। তিনি বললেন,? ‘আল্লাহ যে তোমাকে এই নিরীহ প্রাণীটির মালিক বানালেন, এর ব্যাপারে তুমি কি আল্লাহকে ভয় করো না? উটটি আমার কাছে অভিযোগ করেছে, তুমি একে ক্ষুধার্ত রাখ এবং কষ্ট দাও।’ (সুনানে আবু দাউদ : ২৫৪৯)।
একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি উটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, ক্ষুধার তাড়নায় যার পিঠ পেটের সঙ্গে লেগে গেছে। অনাহারে, অপুষ্টিতে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ দৃশ্য দেখে রহমতের নবীর ভীষণ মায়া হলো। সাহাবিদের ডেকে বললেন : ‘এসব বাকশক্তিহীন প্রাণীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। সুস্থ অবস্থায় এগুলোতে আরোহণ করো, সুস্থ অবস্থায় আহার করো।’ (আবু দাউদ : ২৫৪৮)।
নবীজি মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য যেমন পদক্ষেপ নিতেন, তেমনি জীবজন্তু-পশু-পাখির প্রতিও দয়া প্রদর্শন করতেন। তাই তিনি সর্বদা তাদের অধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রাণীদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে বলেন : ‘নিশচয় আল্লাহ তায়ালা কোমল হৃদয়বান, তিনি কোমলতা পছন্দ করেন, তিনি এতে আনন্দিত হন এবং সাহায্য করেনÑ যা কঠোরতার সময় করেন না। যখন তোমরা এসব বাকশক্তিহীন সওয়ারির ওপর আরোহণ কর, তখন তাকে সাধারণ মঞ্জিলে নামাও (অর্থাৎ স্বাভাবিক দূরত্বের অধিক চালিয়ে অধিক কষ্ট দিও না)। যেখানে বিশ্রাম করবে, সেখানকার জায়গা যদি অনুর্বর হয় এবং ঘাস না থাকে তবে শিগগিরই সেখান থেকে তাকে বাইরে নিয়ে যাও, নতুবা এর হাড় শুকিয়ে যাবে। (অর্থাৎ ঘাসপাতাহীন জায়গায় বিলম্ব করলে তারা না খেয়ে শুকিয়ে যাবে। ফলে হাঁটতে পারবে না)। আর তোমাদের জন্য রাত্রে ভ্রমণ করাই উচিত। কারণ রাত্রে যে পরিমাণ পথ অতিক্রম করা যায় দিনে তা হয় না। রাত্রে যদি কোনো স্থানে অবস্থান কর, তবে পথে অবস্থান করো না। কেননা সেখানে জীবজন্তু চলাফেরা করে এবং সাপ বাস করে। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক : ১৭৬৭)।
পশু-পাখির প্রতি নম্রতা প্রদর্শন ইবাদতের পর্যায়ভুক্ত। পশু-পাখিকে কষ্ট দেওয়া গুনাহের কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের ওপর ‘ইহসান’ অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা যখন হত্যা করবে, দয়ার্দ্রতার সঙ্গে হত্যা করবে; আর যখন জবাই করবে তখন দয়ার সঙ্গে জবাই করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার জবাইকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে।’ (মুসলিম : ১৯৫৫)।
পশু-পাখির সঙ্গে যথাসম্ভব দয়াশীল আচরণ করতে হবে। এদের সঙ্গে যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না। পশু-পাখির অঙ্গহানি করা নিষিদ্ধ।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন, যে প্রাণীদের অঙ্গচ্ছেদ করে।’ (বোখারি, হাদিস নং : ৫৫১৫)।
একবার আবদুল্লাহ ইবনে (রা.) কিছু কুরায়শ যুবকের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা একটি পাখি বেঁধে সেটির দিকে তীর নিক্ষেপ করছিল। আর প্রত্যেকটি নিশানা ব্যর্থ হওয়ার কারণে তারা পাখির মালিকের জন্য একটি করে তীর নির্ধারণ করছিল। তারপর তারা ইবনে ওমরকে দেখে আলাদা হয়ে গেল। ইবনে ওমর বললেন, কে এ কাজ করল? যে ব্যক্তি এরূপ করেছে তার প্রতি আল্লাহর লানত। যে কোনো জীবজন্তুকে লক্ষ্যস্থল বানায় রসুলুল্লাহ (সা.) তাকে লানাত করেছেন। (মুসলিম : ১৯৫৮)।
আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,? ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) (প্রাণীর) মুখে আঘাত করতে এবং মুখে সেক লাগাতে বারণ করেছেন।’ (মুসলিম : ২১১৬)।
যে কোনো প্রাণীকে ভালোবাসতে হবে। অযথা কষ্ট দিলে অবশ্যই এর শাস্তি ভোগ করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চড়–ইকে অযথা হত্যা করল, তা কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার কাছে উঁচুস্বরে ফরিয়াদ করে বলবে : ইয়া আল্লাহ! অমুক ব্যক্তি আমাকে হত্যা অযথা করেছিল, সে কোনো লাভের জন্য আমাকে হত্যা করেনি।’ (নাসায়ি : ৪৪৪৬)।
বিড়ালকে কষ্ট দেওয়ার কারণে এক মহিলাকে জাহান্নামে যেতে হয়েছিল। রাসুল (সা.) বলেন, ‘এক নারীকে একটি বিড়ালের কারণে আজাব দেওয়া হয়েছিল। সে বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল। সে অবস্থায় বিড়ালটি মরে যায়। মহিলাটি ওই কারণে জাহান্নামে গেল। কেননা সে বিড়ালটিকে খানাপিনা কিছুই করায়নি এবং ছেড়েও দেয়নি; যাতে সে জমিনের পোকা-মাকড় খেয়ে বেঁচে থাকত। (বোখারি : ৩৪৮২)।
রাসুল (সা.) প্রাণীকে কষ্ট দিয়ে এক মহিলার জাহান্নামে যাওয়ায় কথা যেমন বর্ণনা করেছেন, তেমনিভাবে এদের প্রতি সহনশীলতা ও মমতা প্রদর্শন করে এক ব্যক্তির জান্নাতে যাওয়ার ঘটনাও বর্ণনা করেছেন এভাবেÑ ‘রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে এক ব্যক্তির ভীষণ পিপাসা লাগে। সে কূপে নেমে পানি পান করল। এরপর সে বের হয়ে দেখতে পেল, একটি কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং পিপাসায় কাতর হয়ে মাটি চাটছে। সে ভাবল, কুকুরটারও আমার মতো পিপাসা লেগেছে। সে কূপের মধ্যে নামল এবং নিজের মোজা ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে সেটি ধরে উপরে উঠে এসে কুকুরটিকে পানি পান করাল। আল্লাহ তায়ালা তার আমল কবুল করেন এবং তার গোনাহ মাফ করে দেন। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! চতুষ্পদ জন্তুর উপকার করলেও কি আমাদের সওয়াব হবে? তিনি বললেন, প্রত্যেক প্রাণীর উপকার করাতেও পুণ্য রয়েছে। ( বোখারি : ২৩৬৩)।
আসুন, সব ধরনের প্রাণীর প্রতি সদয় ও স্নেহশীল হই। তাদের জন্য ভালোবাসা ও মমতা লালন করি এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য রক্ষায় মনোযোগী হই।