শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও গণতন্ত্রের বিজয়—সাইদুল করিম মিন্টু
ঝিনাইদহের চোখঃ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। একটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন। আরেকটি ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসার ঘটনা ছিল বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের আরেক আশীর্বাদ এবং বিজয়ের পূর্ণতা। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তির গভীর ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য। এর ফলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের পরিপন্থি পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল ধারার প্রত্যাবর্তন ঘটে।
স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিদেশে থাকায় শেখ হাসিনা ও তাঁর আপন বলতে একমাত্র ছোট বোন শেখ রেহানা সেদিন প্রাণে বেঁচে যান। ওয়াজেদ মিয়ার জার্মান ভিসার মেয়াদ শেষ হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভারতে অবস্থান করেন। সামরিক শাসক জিয়া তখন শেখ হাসিনার দেশে ফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখে।
১৯৮১ সালের ১৭ মে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সেদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। সে হিসেবে ১৭ মে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরলেন। সেই সময় আমি সরকারি ঝিনাইদহ কে. সি কলেজের ছাত্র ছিলাম। তখন কলেজের ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম। তবে ১৯৭৮ সালে ঝিনাইদহ সরকারি স্কুলে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। বাবা রাজনীতি করতো। আর আমি ছাত্রলীগ কর্মী হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন সেই জনতার ঢলে আপাকে এক নজর দেখতে উপস্থিত হয়েছিলাম।
ওই দিনটি ছিল রবিবার। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত এলাকাজুড়ে লাখো জনতার ঢল নামে। শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান ছুঁয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। বাবা-মা-ভাইসহ পরিবারের সব সদস্যের রক্তে ভেজা বাংলার মাটি স্পর্শ করে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই সময় ‘উন্মত্ত’ জনতা সামরিক শাসক জিয়ার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিভিন্ন স্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। ঝড়-বৃষ্টির আকাশ কাঁপিয়ে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকের চারপাশে স্লোগান ওঠে- পিতৃ হত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই/রাজপথ ছাড়ি নাই।
তিল ধারণের জায়গা ছিল না সেদিন কুর্মিটোলা থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত। লাখ লাখ লোকের সংবর্ধনায় তিনি জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার বিচারের দাবি ও বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।”
সংবর্ধনার পর শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারের সদস্যদের রক্তে রঞ্জিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের ৩২ নম্বর বাসায় প্রবেশ করতে চাইলে জিয়ার বাহিনী তাঁকে তাঁর পৈত্রিক বাসায় প্রবেশ করতে দেয়নি। সেদিনের শাসক গোষ্ঠী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার বিষয়টিকে কতোটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল জানি না। আমাদের দেশের নানা মহলও শেখ হাসিনাকে নিয়ে কতোটা আশাবাদী হতে পেরেছিল সেটিও জানা নাই। কেননা, তখন পর্যন্ত অনেকেই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মিশন-ভিশন সম্পর্ক সচেতন ছিলেন না। জিয়াউর রহমান এবং ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের হোতাদের একটা ধারণা ছিল যে, শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের সমর্থনশক্তি কিছুটা জেগে উঠবে হয়তো। কিন্তু সেটি তাদের রাজনীতির জন্যে হুমকি হয়ে পড়বে তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। আওয়ামী বিরোধী সকল শক্তির ধারণা ছিল যে, আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে কোনোভাবেই আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না, কেননা, বাংলাদেশের জনগণকে এরইমধ্যে আওয়ামী বিরোধী ভাবাদর্শে গড়ে তোলা গেছে, সাম্প্রদায়িক এবং ভারত বিরোধী করা গেছে সফলভাবে; এমনটিই ভাবা হতো।
আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের মতো হয়তো দুর্বল হতে পারে, নতুবা এটি চিরকালই বিরোধী দলের আসনে বসে চেঁচামেচি করে কাটাবে; এমনটিই তাদের ধারণা ছিল। ১৯৮১ সালের দিকে বাংলাদেশের রাজনীতি এতোটাই বিভ্রান্ত এবং পথহারা ছিল, আওয়ামী লীগ তো অনেকটাই নেতৃত্বশূন্যই ছিল। তার ওপর এই দলটির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা এতোটাই তীব্র ছিল যে, সেসবকে প্রতিহত
করে রাজনীতির মাঠে নতুনভাবে দাঁড়ানো মোটেও সহজ কাজ ছিল না।
তারপর শেখ হাসিনা দলের হাল ধরলেন, নতুন করে সবকিছু গোছাতে লাগলেন, অভিজ্ঞতার অবস্থানটিও তখন তাঁর ছিল যৎসামান্য, দলের রণনীতি, রণকৌশল নির্ধারণ, দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সামরিক শাসন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজালকে ছিন্ন করে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তখন পর্যন্ত বেশ জটিল এবং দুরুহ কাজ ছিল। তারপরও পিতার মতো বরাবরই তিনিও ছিলেন ঘাতকের ষড়যন্ত্রের টার্গেট। তাকে হত্যা করার যড়য়ন্ত্র শুরু হয়েছে তখন থেকেই।
এর আগে বিদেশে থাকাকালীন অবস্থায় এই জাতির গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তারপর থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। রাজ্জাক ভাইয়ের মতো লোক আপা আসার দুই বছর পর আওয়ামী থেকে বের হয়ে বাকশাল গঠন করে। এমনকি ড. কামাল হোসেনের মতো আওয়ামী লীগ নেতা দল থেকে বের হয়ে যায়। তারপর ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসে। তবে যদি ঐসময় ষড়যন্ত্র না হতো তাহলে '৮৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতো। তবুও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে এগিয়ে যায়।
এদিকে একবার নয়, দুইবার নয়, শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কখনো নিজ বাসভবনে, কখনো জনসভায় আবার কখনো তার গাড়ির বহরে। ক্ষমতায় যাতে শেখ হাসিনা কোনোভাবে যেতে না পারেন এবং ষড়যন্ত্রের গোপন জাল বিছিয়ে রেখেছিল রাষ্ট্রক্ষমতার ভেতরে মুখ লুকিয়ে যারা বেঁচেছিল। গোটা আশির দশক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। কিন্তু আন্দোলনের কোনো ফসলই তাকে ঘরে তুলতে দেয়নি নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারী মহল। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সর্বাধিক ত্যাগ স্বীকার করার পরেও এ পরাজয় অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে বিএনপিবিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু করেন শেখ হাসিনা। তার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১২ জুন ১৯৯৬
সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং ২৩ জুন ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তবে ২০০৯ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতারা আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল। নিজে বাঁচার জন্য ভয়ে মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছিল। তারা বিশ্বাস করতে পারেনি আওয়ামী লীগ ভোটে নির্বাচিত হবে। তবে শেখ হাসিনার বিশ্বাস ছিল ভোটে বিজয়ী হবে। তখন আমি কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম। আর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কৃষিবিদ বাহাউদ্দীন নাসিম ভারতে ছিলেন। আর সাধারণত সম্পাদক পংকজ কুমার নাথ জেলে ছিলেন। তখন শুধু ফখরুদ্দীন ও মঈন উদ্দিনের তত্ত্বাবধায় সরকারকে ভয় করেছি। বর্তমান সভাপতি নির্মল গুহসহ কিছু কর্মী নিয়ে রাজপথে ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছি। স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃত্বে লিফলেট, পোস্টার লাগিয়েছি। তখনকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আর আমার মতো ক্ষুদ্র কর্মীরা মাঠে ছিলাম। যে কারণে আপার দৃঢ় নেতৃত্বে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে।
বাংলাদেশে এর আগে কেউ এত বছর সরকারপ্রধান হতে পারেননি। এর বাইরে ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি তিনটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর আবার জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে বিএনপিকে চাপ দিয়ে তাদেরকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮১ সালের ১৭ই মে শেখ হাসিনার দুঃসাহসী সিদ্ধান্তের কারণেই আজ সামরিক শাসনের স্মৃতি পেছনে ফেলে দেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে। শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে বিশ্বনেত্রী হিসেবে রাজনীতির মাঠে নতুন জোয়ারের সৃষ্টি করেছেন। নিজেকে মানবিক নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জনগণের নেত্রীর জয় হোক।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ