সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের জীবনবোধ-যা তার আচরণের মাধ্যমে ফুটে ওঠে-এম এ কবীর (সাংবাদিক)
ঝিনাইদহের চোখঃ
সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের জীবনবোধ ও বিশ্বাসের প্রতিরূপ যা তার আচরণের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। বলা হয়ে থাকে সংস্কৃতি হল মার্জিত জীবনাচার। তবে একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কতটা শিষ্ট ও মার্জিত হবে তা নির্ভর করে তার জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ধারণা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ঋদ্ধতার উপর। কেননা, মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ভাবনা বা ভাল-মন্দের বোধ। মানুষের জীবনবোধের বিন্যাসে এবং একটি জাতির মানস গঠনে ইসলামের একটি বিরাট ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কেননা, ইসলাম জীবন ও জগৎ সম্পর্কে একটি বিশিষ্ট ধারণা বা বিশ্বাস প্রদান করে। কাজেই ঈদ উৎসবে আদর্শের একটি প্রভাব থাকা স্বাভাবিক এবং যারা ইসলামের আদর্শকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন তাদের উচিত বল্গাহীন উল্লাসে গা ভাসিয়ে না দিয়ে ঈদের তাৎপর্যকে স্মরণে রাখা এবং তাকে অনুসরণ করা।
পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম সাধনার পর যে ঈদ আমরা পালন করি তার সুস্পষ্ট নির্দেশদাতা হলেন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন। আল্লাহ বলেন-
‘হে লোক সকল, তোমাদের কাছে তোমাদের আল্লাহ’র কাছ থেকে নসিহত (কোরআন) এসে পৌঁছেছে; এতে রয়েছে অন্তরের রোগের পূর্ণ নিরাময়; আর যে তা কবুল করবে তার জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে পথনির্দেশ এবং রহমত। (হে নবী) বলুন : এটা আল্লাহ’র অনুগ্রহ ও অপার করুণা যে, তিনি এই প্রত্যাদেশ নাযিল করেছেন। এজন্য তো লোকদের আনন্দ-উৎসব করা উচিত। এটা সেসব থেকে উত্তম, যা লোকেরা সংগ্রহ ও আয়ত্ত করে থাকে।- [সূরাহ ইউনুস: আয়াত ৫৮]
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের নির্দেশে মহানবী (সা.) মুসলমানদের জন্য দুটি উৎসব পালনের ঘোষণা দেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক জাতিরই উৎসব রয়েছে, আমাদের উৎসব হলো ঈদ।’’
রোজা ভাঙ্গার আনন্দই ঈদুল ফিতর। ফিতর অর্থ ভাঙ্গা। ঈদুল ফিতর অর্থ তাই রোজা ভাঙার আনন্দ। তবে এই আনন্দ তারাই উপলব্ধি করে থাকেন যারা পুরো রমজান মাস জুড়ে রোজা রাখেন। যারা সারা মাস সিয়াম সাধনা করেছেন, রহমত, বরকত ও মাগফিরাত লাভের চেষ্টা করেছেন। তাদের নিকট বরং ঈদ হলো পাপমুক্তির আনন্দ। সফলতা ও বিজয়ের আনন্দ। এ বিজয় নাফসের ওপর আকলের, এ বিজয় শয়তানের ওপর ইনসানের।
হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর একটি কবিতায় বলেছিলেন-
ঈদ আসেনি তাদের তরে, যারা পরেছে নতুন বেশ
খোদার ভয়ে পূর্ণ যে মন, তারই তরে ঈদের রেশ।
ঈদ সবার হয় না। সব বছর হয়না। সবার একইভাবে হয়না।
একেকটা ঈদ আসে হরবছর। সব ঈদে আনন্দধারা আমরা যতটা মাপতে পেরেছি, কষতে পেরেছি ঈদ আনন্দের অংক, তার চেয়ে অশ্রæধারা যে কম মেপেছি তা কিন্তু নয়।
ঘরমুখো মানুষ মরেছে বেঘোরে। বেপরোয়া গাড়ির তলায়। ধাক্কায়। অধিক বোঝাই লঞ্চ-ট্রলার ডুবি। হয়েছে অনেক সলিল সমাধি। বোনাস না পেয়েছে কেঁদেছে পিতা। মন খারাপের দৃশ্যপটে কেটেছে পরিবারের দিন। পকেটমারের হাতে হারিয়েছে স্বর্বস্ব। পথেরপাশে ব্যাকুল যুবকের হাতপাতা। অজ্ঞানপার্টির মলমে চোখ লাল করে ঘরে ফেরা অনেক ‘বেকুব’ বাবা। এমনই সব ঈদের সকাল। তাদের কী ঈদ হয়েছে ? হয়নি। ঈদ যেমন হয়নি। প্রতিকারও হয়নি। এমন সব অনুসঙ্গ লেগেইতো ছিলো জীবনে।
এবার না হয় সেসবের পরিবর্তে এসেছে এক অদৃশ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু। কেউ জানেনা কে কোথায় কিভাবে বহন করছে। আগে ঈদ-আনন্দ বানচালে যারা দায়ী ছিলো তাদের চিহ্নিত করা যেত। বেপরোয়া চালক। পকেটমার। বাটপার কিংবা সন্ত্রাসী। এখন আপনি নিজেই হতে পারেন নিজের আনন্দ মাটি করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
এ এক বেদনাকাল। এ বেদনায় সামিল সবাই। নামিয়ে এনেছে এক কাতারে। ধনী-গরিবের ফারাক নাই।
জাতীয় কবির ভাষায়—
‘হিন্দু নাকি মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন।
কান্ডারি বলো মরিছে মানুষ- সন্তান মোর মা’র।’
কত মায়ের সন্তান যাচ্ছে কবরে। চিতায়। কিচ্ছুটি করার নেই। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। আক্রান্তের সংখ্যা। আইসিইউতে আর একটি বেডও ফাঁকা নেই। অক্সিজেন সাপোর্টটুকুও নেই। ভবিষ্যৎ কী বুঝে নেয়া সহজ।
রবি ঠাকুর লিখেছেন – ‘আপনা মাঝে শক্তি ধরো নিজেরে করো জয়’। ( ‘সেল্ফ হেল্প ইজ দ্য বেস্ট হেল্প’ )
ঝবষভ যবষঢ় রং ঃযব নবংঃ যবষঢ় – এই ইংরেজি আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে ভাবা দরকার। এই যুদ্ধে সকলেই সৈনিক। যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের সারিয়ে তুলতে সম্মুখ সারিতে যুদ্ধ করছেন একদল। একজন যোদ্ধা হিসেবে আপনি তো নিজেই নিজেকে পারেন সামলে রাখতে। নিজের বর্ম নিজেই সৃষ্টি করতে পারেন। এই যুদ্ধাবস্থায় সামান্য বর্মচ্যুত হয়েছেন তো মরেছেন।
ঈদটা অতিমাত্রায় উপভোগের দরকার নেই। বেঁচে থাকার চেষ্টা করুন। লড়াইটা বেঁচে থাকার । বড় জয়ের। বেশি আনন্দের।
আজ নয়, কাল। নয়তো পরশু। তখন না হয় দ্বিগুণ আনন্দ করে নেবেন।
কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন–
“ ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক
দোস্ত দুশমন পর ও আপন
সবার মহলে আজি হউক রওনক ।।
যে আজ দূরে যে আছ কাছে
সবারে আজ মোর সালাম পৌঁছে ,
সবারে আজ মোর পরাণ যাচে
সবারে জানাই এ দিল আশক।”
তিনি ইসলামি ঐতিহ্যের জয়গান গেয়েছেন, মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ববোধ বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। ঈদের আনন্দকে সার্বজনীন করে – ‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন –
শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো/কত বালুচরে কত আঁখি ধারা ঝরায়ে গো/বরষের পর আসিলে ঈদ!/ভূখারির দ্বারে সত্তগাত বয়ে রিজওয়ানের/কণ্টকবনে আশ্বাস এনে গুলবাগের…/আজি ইসলামের ডঙ্কা গরজে ভরি জাহান/নাই বড়-ছোট -মানুষ এক সমান/রাজা প্রজা নয় কারো কেহ-।
কবি কায়কোবাদ ‘ঈদ আবাহন’ কবিতায় তার অভিব্যক্তি এভাবে তুলে ধরেছেন-
‘এই ঈদ বিধাতার কী যে শুভ উদ্দেশ্য মহান, হয় সিদ্ধ, বুঝে না তা স্বার্থপর মানবসন্তান। এ তো নহে শুধু ভবে আনন্দ উৎসব ধুলা খেলা। এ শুধু জাতীয় পুণ্যমিলনের এক মহামেলা।’
কবি গোলাম মোস্তফা কতই চমৎকারভাবে তার এক কবিতায় বিষয়টি এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন-
‘আজি সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মূর্তি লভিয়াছে হর্ষে, আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়েছে রাখিতে হবে সারা বর্ষে, এই ঈদ হোক আজি সফল ধন্য নিখিল-মানবের মিলন জন্য, শুভ যা জেগে থাক, অশুভ দূরে যাক খোদার শুভাশিস স্পর্শে।’
আমরা স্থায়ীভাবে অভাব দূরকরতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো। প্রকৃত ঈদ উদযাপন হবে
তখনই । আমাদের এভাবে খুশি হওয়াও উচিত নয়। ঈদের দিনে গরিবদের সাময়িক খুশির উপকরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিবলে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা স্থায়ী খুশির উপকরণের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করি।
‘ঈদ’ – কৃতজ্ঞতার অপর নাম। ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিই। তাহলে দেখতে পাই, আল্লাহর কৃতজ্ঞতার ক্ষেত্রে সাহাবিরা কতই না উন্নত মানের ছিলেন।
হজরত আব্দুর রহমান বিন আউফ সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে –
তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য আরম্ভ করেন, আর তার ব্যবসা এত লাভজনক প্রমাণিত হয় যে, তিনি নিজেই বলতেন, আমি যে বস্তুতেই হাত দিতাম আল্লাহ-তাআলা তাতে এত বরকত রেখে দিতেন যা ছিল কল্পনাতীত। আমার স্পর্শে মাটি সোনা হয়ে যেত। তাকে আল্লাহ-তাআলা অশেষ ধনভান্ডার দিয়েছেন, কিন্তু সেই সম্পদ পাওয়ার পরও তার আচরণ কেমন ছিল ? তা কি বস্তুবাদী মানুষের ন্যায় ছিল?
একদিন তিনি রোজা রেখেছেন। ইফতারির সময় যখন তার জন্য খাবারের বিছানা বিছানো হয় তখন সেখানে বিভিন্ন প্রকার খাবার দেখে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। ইসলামের প্রথম যুগের কথা স্মরণ করেন, যখন দিনের পর দিন মানুষকে অনাহারে কাটাতে হতো, তখন তার নিজের অবস্থাও তেমনই ছিল।
সেই সমস্ত সাহাবিদের কুরবানির কথা তার স্মরণ হয়, যখন যুদ্ধের ময়দানে তারা শহীদ হতেন তখন তাদের জন্য পর্যাপ্ত কাফনও ছিল না। আর যে চাদর ছিল তা এত ছোট যে, মাথা ঢাকলে পায়ে কোনো সতর থাকতো না আর পা ঢাকলে মাথা খোলা পড়ে থাকতো। তাই আল্লাহ যাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছেন তাদের উচিত হবে করোনাকালীন এ ঈদে গরিব অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো।
ভাবতেই ভয় লাগে! মন বলে- এভাবে চললে আর কোনোদিন কি আমরা আগের মতো ঈদ করতে পারব? আমরা কি সবাই মিলে দলবেঁধে হৈহুল্লোড় করতে করতে বাইরে বের হতে পারব? আগের মতো কি বিশাল ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে না? আমরা কি আর আগের মতো ঈদের দিনে কোলাকুলি করতে পারব না? আমরা কি ঈদের দিনে আগের মতো প্রিয় মানুষের সঙ্গ পাব না?
মানুষ দেখলেই কি মনে নানান প্রশ্ন জাগবে? অদৃশ্য জীবাণু কি শেষপর্যন্ত আমাদের বিশ্বাসেও আঘাত হানবে? তাহলে আগামী ঈদগুলো হবে কি এমনই বর্ণহীন, নিষ্প্রাণ, অনুজ্জ্বল আর ভয়ে ভরা?
নিজেকে যেমন এভারগ্রিন দেখাতে চাই, প্রকৃতিকেও তেমন সবুজ রাখার চেষ্টা করব। নিজেদের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে লোভকে নিচে নামিয়ে আনব। দেখব, ধীরে ধীরে পৃথিবী আবার সজীব, দূষণমুক্ত হয়ে নতুনভাবে মেরামত হয়েছে। মানুষের সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণেই অদৃশ্য জীবাণু বাধ্য হয়েছে বিদায় নিতে। তখনই আমরা আবারও মেতে
পুরনো দিনের মত ঈদ আনন্দে।
এমন একটি ঈদ আসবে জীবনে তা হয়তো কারোর-ই জানা ছিলো না। কিন্তু ঈদ তো এমনও নয় যে, সকলের জন্য সববছরই পরমানন্দের হয়ে ধরা দেয়।
১৯১৮-১৯ সালে স্প্যানিশ ফ্লু (স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা) মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। বলা হয়ে থাকে সে সময় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশেরই মৃত্যু হয় ওই ভাইরাসে। গত এক‘শ বছরে বিষাদ বেদনায় দু’বার ঈদুল ফিতর পালিত হয়। একবার ১৯৭১ সালে (২০ নভেম্বর) মুক্তিযুদ্ধের সময়, আর এবার (২৫ মে ২০২০) মরণঘাতী করোনাকালে।
একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঈদে প্রচার করা হয় এই গান —
‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও, দেখো, মানুষের খুনে খুনে রক্তিম বাংলা,/ রূপসী আচঁল কোথায় রাখবো বলো?’
গীতিকার শহীদুল ইসলামের লেখা এই গান প্রাণ পায় প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী সুরকার অজিত রায়ের সুরে। কণ্ঠশিল্পী রূপা ফরহাদ সহ অনেকে এই গানে কণ্ঠ দেন।
আমাদের জীবনে আসে জরা, আসে দুঃখ, আসে বেদনা। সে আসাটা খুব যে বলে কয়ে আসে তাও তো নয়। ঈদ-চান্দ দেখেও আসে না।
‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসেনি নিদ।
মুমূর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ ?’
কাজী নজরুলের তুলে আনা সে প্রশ্নের উত্তর আজো জানা হয়নি। কেউ দিতেও পারেনি। দেয়ার সাহসও করেনি।