ভার্চুয়ালে মাদক ও চোরা কারবারি প্রতিরোধে আইনী প্রতিকার আছে কি ?–মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম (আইন বিশ্লেষক এবং বিচারক)
ঝিনাইদহের চোখঃ
লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, কলামিস্ট ও আইন বিশ্লেষক এবং বিচারক, বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস।
প্রতিবছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালিত হয়। এবারে এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, “শুদ্ধ জ্ঞানেই সঠিক যত্ন হবে, জ্ঞানের আলোয় মাদক দূর হবে।’ তবে বিস্তারিত আলোচনার আগে এ দিবসের ইতিহাস জানা দরকার। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে উৎপাদিত আফিম দিয়ে চীনকে অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করতে থাকে, এর প্রতিক্রিয়ায় চীনের সম্রাট মাদকের বিরুদ্ধে ১৮৩৯ সালের এই দিনে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ব্রিটেনের সঙ্গে চীনের এই যুদ্ধই ইতিহাসে প্রথম আফিম-যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই চীন আধুনিক যুগে প্রবেশ করে এবং উন্নতির পথে নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এখনকার চীনের সার্বিক অবস্থা সকলেই জানে।
করোনার কারণে দেশব্যাপী অত্যন্ত সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দিবসটি পালন করবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ফেসবুকে মাদকবিরোধী প্রচার কার্যক্রম চালানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মাদকের সর্বব্যাপী বিস্তার ঠেকিয়ে তরুণ প্রজন্মকে এর অভিশাপ থেকে রক্ষায় ২০১৮ সালের ৪ মে দেশজুড়ে বিশেষ অভিযান শুরু করে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। এরপর পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাও মাদকবিরোধী অভিযান চালায়। অভিযানে এখন পর্যন্ত কয়েকশ’ ব্যক্তি মাদককারবারে জড়িত থাকায় অভিযুক্ত হিসেবে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়। গ্রেপ্তার হয় কয়েক হাজার। তবু মাদক নির্মূল করা যায়নি। মাদক কারবার চলছেই।
কোনভাবে যখন মাদকদ্রব্য অপরাধসমূহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভবপর হচ্ছিল না ঠিক তখনি মাদক সক্রান্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য বর্তমান সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে। যার ফলশ্রুতিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনটি অত্যন্ত সূদুরপ্রসারি এবং যুগোপযোগী করে নীতি নির্ধারকরা প্রস্তুত করেছেন বলে মনে হয়। সমসাময়িক আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হতে পারে এমন কোন সংজ্ঞা, উপাদান ও আলোচনা নেই যা এই আইনে অন্তর্ভূক্ত করা হয় নাই। ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইনটি বর্তমানে অপরাধের ধরণ ও ঘটনার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিলো না। যেহেতু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ রহিত করা হয় সে কারণে মাদক দ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুণর্বাসন ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী করাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিধান বিষয় সংবলিত একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮-এ ৩৮টি সংজ্ঞা রয়েছে, যার মধ্যে ১৮টি নতুন সংজ্ঞা। মাদকসংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের অপরাধের ধরন বিবেচনা করে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য সেবন করে কেউ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় জনগণের শান্তি নষ্ট করলে বা একই অপরাধ তিনবার করলে, তার সাজা হবে।
মাদক সংক্রান্তে কিছু তথ্য, পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা, বাংলাদেশ প্রেক্ষিতঃ করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারিও মাদককে রুখতে পারেনি। দুই বছরে এক হাজার কোটি টাকার মাদক উদ্ধার রর্যাবের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ২০১৮ সালের ৩ মে থেকে চলতি বছরের ২০ জুন পর্যন্ত শুধু র্যাব সারাদেশ থেকে এক হাজার তিন কোটি ৭৭ লাখ টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। এই দুই বছরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৫১৭ জন মাদক কারবারিকে। হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে ৮৪ কেজি। এক কোটি ৫২ লাখ ২৩ হাজার ৬৭৩ পিস ইয়াবা বড়ি, দুই লাখ ৭৪ হাজার ৩০৩ বোতল ফেনসিডিল, আট হাজার ৫৫৪ কেজি গাঁজা, প্রায় দুই কেজি কোকেন, ছয় লাখ ৪৭ হাজার ২১৪টি নেশাজাতীয় ইনজেকশনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার করা হয়। মার্চের পর করোনা পরিস্থিতির এই চার মাসে র্যাব অভিযান চালিয়ে সারাদেশে অন্তত দুই হাজার মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করে। ১০ লাখের বেশি ইয়াবা জব্দ করা হয়।
গত মে মাসে র্যাব ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে মাদক কেনাবেচা করছিল এমন একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সন্ধান পায়। ওই গ্রুপের নাম ছিল ‘ওয়েড লাভারস বা গাঞ্জা প্রেমী।’ অনলাইনে অর্ডার নিয়ে মাদকের হোম ডেলিভারি দিচ্ছিল তারা। ওই গ্রুপে অন্তত ১৫ হাজার সদস্য ছিল। করোনাকালে এ ছাড়া রাজধানীর আগারগাঁওকেন্দ্রিক একটি চক্রের খোঁজ পায় পুলিশ। যারা মূলত সবজি বিক্রেতার আড়ালে মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা, গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদক পৌঁছে দেয়। ফোনে অর্ডার নিয়েই তারা এই সিন্ডিকেট সচল রাখছিল।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে সারাদেশে মাদক মামলা হয়েছে সাত হাজার ৬২৫টি। এপ্রিল মাসে এই মামলা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৪০টিতে। মে মাসে মামলার সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪৬৫টি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, স্বাভাবিক সময়ে গড়ে প্রতি মাসে ঢাকায় মাদক উদ্ধারজনিত ২৫০-৩০০ মামলা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। করোনাকালে মামলার সংখ্যা গড়ে মাসে একশ’তে নেমে এসেছে। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য- করোনার এই সময়ে আগের মতো ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালানো সম্ভব নয়। কারণ কোনো একটি ইউনিটের একজন সদস্য করোনা আক্রান্ত হলেই ওই ইউনিটের সব সদস্যকে কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হচ্ছে। আবার অভিযান চালাতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। খিলগাঁওয়ে একটি টিম অভিযান চালাতে গেলে ঘরের ভেতর থেকে এক ব্যক্তি বলেন- ‘আমি করোনা রোগী। অভিযান চালাতে আপনারা বিপদে পড়তে পারেন।’ এটা জানার পর অভিযান থেকে সরে আসেন তারা।
মাদক ঠেকাতে অন্যান্য বাহিনীর মতো সীমান্তে দায়িত্ব পালন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি। মার্চে ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৮২ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৪০ হাজার ৩১৪ বোতল ফেনসিডিল, ৯২৮ কেজি গাঁজাসহ নানা মাদক জব্দ করা হয়। বিজিবির অভিযানে এপ্রিল মাসে তিন লাখ ১০ হাজার ৬২১ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ২২ হাজার ৯৫১ বোতল ফেনসিডিল, ৫৬০ কেজি গাঁজা, ৪০০ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়। মে মাসে চার লাখ ৪৭ হাজার ৮৬৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৩৩ হাজার ৯৩৩ বোতল ফেনসিডিল, এক হাজার ২৮৭ কেজি গাঁজা, এক কেজি ৩৮৩ গ্রাম হেরোইনসহ অন্যান্য মাদক উদ্ধার করে বিজিবি। (সূত্রঃ সমকাল অনলাইন)
মাদকাসক্তি প্রতিরোধে যা করা যেতে পারে তা সংক্ষেপে তুলে ধরবো বা আজকে লেখার মধ্যে আমার কি পরামর্শ তা আলোকপাত করবো। যথাঃ ১) সকলের সমন্বিত সচেতনতা (Awareness) ও মনের রাগ বা ইচ্ছা শক্তিই আসল। ২) মাদকাসক্তি ঠেকাতে প্রথম প্রতিরোধ পরিবার থেকেই আসতে হবে । ৩) যুবসমাজকে খেলাধুলা ও সৃষ্টিশীল কাজের সুযোগ করে দিতে হবে, সচেতনতা বাড়াতে হবে। ৪) মাদকাসক্ত বন্ধু বা পারিপার্শ্বিকতা না ছাড়লে মাদক ছাড়া কঠিন হয়ে পড়ে। ৫) একজন মা হিসেবে আপনিই হচ্ছেন তার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। উপরে উল্লেখিত যে কোনো নেগেটিভ পরিবর্তন সন্তানের মাঝে দেখলেই সন্তানকে বুকে টেনে নিয়ে বুঝাতে হবে। ৬) পারিবারিক বন্ধন ও শিক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসন, সৎ উপার্জন ইত্যাদি পারে মাদক থেকে বাঁচাতে । ৭) Awareness Program শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক বাড়াতে হবে। 8) সংশ্লিষ্টদের এ কাজের প্রতি রাগ (Passion), আন্তরিকতা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে তাদের সন্তানরাও এর বাহিরে নয়।
মাদকাসক্তি প্রতিরোধে ইসলাম ধর্মে কি বলে তা সবাইকে জানানোর চেস্টা করতে হবে। যে বিষয়গুলো বারবার প্রচার করে মাদক সম্পর্কে সচেতনতা সৃস্টি করা যায় তা খেয়াল রাখা। সকল ধর্মে নেশা জাতীয় দ্রব্যকে নিরুতসাহিত করা হয়েছে। ১) মদ জাতীয় সকল দ্রব্য ইসলামে সম্পূর্ণ (Completely Prohibited) হারাম । ২) নবী(সা:) বলেন, “যা বেশি গ্রহণ করলে মাদকতা সৃষ্টি করে তার অল্প গ্রহণ করাও হারাম” (তাহাবী), এখান থেকে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে, “অল্প গ্রহণ” হলো কৌতুহলবশতঃ যা মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। ৩) তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না” (সূরা নিসা:২৯)
মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার ও প্রচারণা করতে হবে মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গীর্জার ফাদারদের মাধ্যমে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে মাদক সেবনের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সকল সরকার, রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদের দেশ ও সমাজের স্বার্থে একই প্লাটফর্মে থেকে কাজ করতে হবে।তাহলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সহজ ও টেকসই হবে।
ধর্মীয় ও সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি বিদ্যমান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনটির কঠোর প্রয়োগ জরুরী। নতুন মাদক আইনে শিশুর বিচার ব্যবস্থা, মাদক ব্যবসার অর্থযোগানদাতা ও পৃষ্ঠপোষক, অডিও ও ভিডিও ইলেকট্রিক ডিভাইসের সাক্ষ্যকে গ্রহণের বিধান, মাদকসেবীদের পুনর্বাসন এবং পুনরায় মাদক অপরাধীর দ্বিগুণ শাস্তি ইত্যাদি সংযুক্ত করা হয়েছে। একারণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এটি মাদক কারবারি প্রতিরোধে একটি যুগান্তকারী ও সময়োপযোগী আইন তা নির্দ্ধিধায় বলা যায়।
বঙ্গবন্ধু মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন এবং তিনি মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মাদক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ধারাবহিকতায় বর্তমান সরকার নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যাতে করে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাদক মুক্ত দেশ হিসাবে রোল মডেল হতে পারে। লেখার শেষে মাদকের ভয়াবহ পরিনতি সম্পর্কে সচেতন (Awareness) হতে মার্কিন ছোট গল্পকার এমব্রোস বাইরেস এর উক্তি মনে করিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেন “মাদক পরিচিতির কারাগারে একটি উন্মুক্ত দুয়ার: এটা আপনাকে নিয়ে যাবে জেলখানার উঠোনে, পরিশেষে ফাঁসির মঞ্চে”।