গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশে বাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ–মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম (কলামিস্ট, গবেষক ও লেখক)
ঝিনাইদহের চোখঃ
কুস্টিয়া জেলার মিরপুর একটি উপজেলা। এখানে অন্যন্যা এলাকার মত প্রতিদিন বাজারে হাজার হাজার লোক সমাগাম হত। হাটের দিনে সে লোকের সমাগম ছিলো আরো বিস্ময়জনক। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরেরও অনেকে আড্ডা দেবার জন্য চায়ের দোকান বা অন্য কোন সুবিধাজনক স্থানে জমায়েত হত। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরুত্ব রক্ষা করে চলা নিজের ও নিজের পরিবারের সুরক্ষার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ও প্রশাসন থেকে এই বিষয়ে চাপ থাকায় লোকজন বাজারে তাদের উপস্থিতি কমিয়ে দিয়েছে। বাজারসহ চিরায়াত জীবন ও জীবিকা পদ্ধতিতে এসেছে জীবনমুখী নানা বিশেষ পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কুস্টিয়ার মিরপুরে শুধু নয় বাংলাদেশের আরো অনেক জেলা উপজেলা বা ইউনিয়নেও সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত।
করোনার সময় একটা কথা প্রায়ই বলে থাকি মাছে ভাতে বাঙ্গালী। হয়ত আগের মত গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা বা নদী ভরা মাছ আমাদের নেই, হয়ত নেই ইলিশের প্রতুলতা কিন্তু তাই বলে বাঙ্গালীর রুচি অভ্যাসে যে আমূল পরিবর্তন হয়েছে তাও নয়। বাজারে গরুর মাংশের দাম বেশী হওয়ায় ও রুচির কারনেই এখনো মাছের প্রতি বিশেষ টান আছে। করোনা, রমজান ও পারিপার্শ্বিকতার কারণে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে মাছের অস্থায়ী দোকান লক্ষ্য করা যায়। তবে সেইসব মাছগুলো খাল, বিল বা নদীর মাছ নয় পুকুরে চাষ করা। এসব দোকান থেকে লোকজন আনন্দের সাথে মাছ ক্রয় করে। স্থানীয় মাছ বিক্রেতা এলাকার মাছের চাহিদা সমন্ধে ভালো ধারণা আছে বলে দ্রুত তার ব্যবসার প্রসার করতে পারে।
সেক্ষেত্রে গ্রামের বাজার বা শহরের বাজার এরকম কোন ভেদাভেদ থাকে না। দৈনন্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে এবং বাংলাদেশের গ্রামীন জনপদ ও তাদের অর্থনীতি উন্নতির দিকে প্রবাহিত হওয়ায় ভাবনার সময় এসেছে যে শুধু শহরে নয়।গ্রামও হতে পারে বাজার ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাণ কেন্দ্র। আর তা কিভাবে হবে তা দেখিয়ে দিতেই মূলত এই লেখা।
পবিত্র রমজান মাসের বাহারী ইফতারির জন্য এক সময় বাজারে বাজারে দোকানে তৈরী করা হত নানা রকম ইফতারের আইটেম। কিন্তু করোনাকালে সে কেন্দ্রীকরণের পরিবর্তন ও লক্ষণীয়। যা চোখে পড়ার মতো। গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ইফতার সামগ্রী বিক্রি করে কিছু লোকজন। গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বড় ধরনের বাজারে যাবার চেয়ে এসব মোড়ে মোড়ে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী দোকান থেকে তাদের প্রয়োজনীয় ইফতারের আইটেম সংগ্রহ করে নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ চালায়।
পরিবহন সমস্যার কারনে পণ্য আনা নেওয়া করার সমস্যা থাকায় স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যও স্থানীয় ভাবে বিক্রি করা হয় স্থানীয় বাজারে। অনেক কৃষি পণ্য উৎপাদক খুচরা বিক্রি করে বেশ স্বাচ্ছন্দবোধ করে আবার অনেক পণ্যে উৎপাদন ও সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম কমে গেছে যা কৃষকদের ক্ষতির কারন। স্থানীয় বাজারে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রাপ্তি অপ্রয়োজনে বাইরে যাবার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। নিয়মিত বাজারের বিকল্প হবার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছে স্থানীয় বাজার। তবে এখানে আশার কথা হলো লোকাল বাজার ব্যবস্থা যে কারণে উন্নতির দিকে তা হলো চলাচলের জন্য রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন এবং পরিবহন ব্যবস্থায় চাঁদাবাজি বন্ধের চেষ্টা।
স্থানীয় স্টেশনারী বা মনোহরী দোকানেও পূর্বের চেয়ে পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করার মাত্রায় পার্থক্য দেখা যায়। অনেক দোকান তাদের গতানুগতিক পণ্যের বাইরে এমন কিছু পণ্য রাখছে যা কিনতে একসময় বাজারে না গেলে হতো না। অনেক ক্রেতা বাজারে যাবার ঝামেলা এড়াতে দোকানের এই সুযোগ গুলো সীমিত পরিসরে হলেও গ্রহণ করার চেষ্টা করছে। অনেকে সময় বাঁচিয়ে অন্য কাজে সময় ব্যয় করতে পারছে পর্যাপ্ত। যেটি গ্রামীন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে বলে সংশ্লিস্টরা মনে করছেন।
স্থানীয় বাজার ব্যাবস্থায় অনেক পণ্যের দাম নিয়ে ক্রেতা বিক্রেতার অসন্তোষ লক্ষ্য করা গেলেও তার সুবিধা কম নয়। দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি বা খাদ্যে ভেজাল মানুষের বিশেষ অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে আছে দীর্ঘদিন। কৃষকরাও তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য বা বাজারজাতকরণ সমস্যা নিয়ে ভুগছিলো। স্থানীয় চাহিদা বা দেশীয় চাহিদার মাপকাটি নির্ধারণ করা বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল।
করোনার এই জটিল পরিস্থিতিতে মানুষ তার চাহিদাকে সীমিত করার চেষ্টার মাধ্যমে যতটুকু পারছে তাদের রুচি অভ্যাস আর আচরণে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে। যদিও একবার তা আশা জাগায় আর একবার তা নিরাশ করে। তারপরেও এই পরিবর্তগুলো ইতিবাচক ও স্থায়ী কোন পরিবর্তনের ইঙ্গিত করে কি না বা ইতিবাচক করা যায় কিনা তা অবশ্যই চিন্তায় রাখা যায ও অবশ্যই রাখা উচিত।
বিনিময় প্রথায় অত্যাবশকীয় বস্তুগুলো প্রাধান্য পেত। প্রয়োজনই জীবনকে প্রয়োজনীয় করে তুলে। কিছুদিন আগেও গ্রামীণ মানুষের চাহিদা ছিলো সীমিত। এখন মোবাইল সেট, টিভি, ফ্রিজ, মটরসাইকেল বা অন্যান্য বিলাস বহুল দ্রব্যও কোন না কোন ভাবে মানুষ তার প্রয়োজনের তালিকায় বুঝে না বুঝে যুক্ত করে ফেলেছিলো যা সামাজিক সম্পর্ক ও শৃঙ্খলায বিশেষ প্রভাব রেখে চলছিলো।
বিলাসবহুল দ্রব্যগুলো প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় যুক্ত করায় বাজার ব্যবস্থায় বিশেষ মাত্রা এসছিলো। এই গন্ডিতে বিশেষ পরিবর্তন আমরা পাই।চাহিদা ও করোনা বা বাজার ব্যাবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ শুধুমাত্র মানুষকে মানুষকে উচ্চাবিলাসী থেকেই নয় অর্থনীতির নতুন গতিপথ নির্ধারনেও নতুন ধারণা দেয়।
বর্তমানে বাজেট পাশ নিয়ে অনেক আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা চলছে এবং এটা আগামী বাজেট না আসা পর্যন্ত চলতে থাকবে।
কিন্তু আমরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি গ্রামীন অর্থনীতি ও গ্রামের বাজার ব্যবস্থা নিয়ে কেউ কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করছি না।যদি বাজার ব্যবস্থা স্বাধীনতা থেকে ৫০ বছর পেরিয়ে এই সময়ে বিকেন্দ্রীকরণ থাকতো তাহলে করোনার সময় স্বাস্থ্যবিধি মানা বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সুবিধা হতো। একটা বাজারে যত লোকসমাগম হয় তা যদি ভিন্ন ভিন্ন বাজারে যেত তাহলে অধিক জনসংখ্যার এই দেশে সংক্রামক রোগ হতে বেঁচে থাকতে সহায়তা করতো। তাই বাজার ব্যবস্থা যদিও ৫০ বছরে বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি তাই করোনাকালে এই সুযোগ কাজে লাগাতে বাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাহলে অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার সাথে সাথে ভাইরাস থেকেও রক্ষা করা যাবে দেশবাসীকে যেটি এই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষ এখন তাদের প্রয়োজনকেই প্রয়োজনীয় করে তুলে জীবন সাজানোর চেষ্টা করছে। কৃষি ও কৃষি পণ্যের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে। শ্রম ও শ্রমিকের যে গুরুত্ব তা হচ্ছে স্পষ্ট। বিলাসিতা ও বিবেক স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। জীবনের চাহিদা কমিয়েও যে নিজেদের সুখী করা যায় এ বোধ তাদের ভিতর জন্ম নিচ্ছে ধীরে ধীরে। ইতিবাচক পরিবর্তনের সাথে কিছু নেতিবাচক পরিবর্তন অবশ্যই আছে। সেটা এই আলোচনাকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে । তবে বাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করার প্রয়োজনীয়তার যে শিক্ষা গ্রামীণ অর্থনীতিতে উঁকি দিচ্ছে তার ফল ইতিবাচক বা নেতিবাচক যে কোনটিই হতে পারে যা নির্ভর করে পদক্ষেপ ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সামগ্রিক সুচিন্তার উপর ।
বাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করতে যা করনীয় বা আমরা যেসব পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারি এবং বর্তমানে করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর শিক্ষা আমরা কাজে লাগাতে পারি ও কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পনা নিতে পারি।
(১) গ্রামীণ অর্থনীতিই খাদ্য মন্দা ও দূর্ভিক্ষ দূর করতে পারে।
(২) আমদানী নয় নিজস্ব পণ্য বাজারজাত ও সংরক্ষণের সহজ সমাধান বাজার ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করা।
(৩)বিলাসবহুল দ্রব্য বা পণ্য মানুষের দক্ষতা ও সৃজনশীলতার বাধা, প্রয়োজনই মানুষের জীবনকে প্রয়োজনীয় করে তুলে।
(৪)শিক্ষা খাতে তথা নৈতিক শিক্ষার বিকাশ ও শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ছাড়া সেবার মান (সার্ভিস ডেলিভারি) উন্নত করা সম্ভব না।
(৫)ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নয় বরং নিজের শ্রম ও তার বাস্তব উপযোগীতাই (উদ্যোক্তা হওয়া নিজে) সব পরিবর্তন করতে পারে।
(৬)উৎপাদন, উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদক, শ্রম ও শ্রমিকের বিকেন্দ্রীকরণ অর্থনীতির মোড় ঘোরাতে যথেষ্ট।
(৭) বাজার চাহিদা তৈরী করে নয় প্রয়োজন ও প্রাপ্তি দিয়েও তৈরী করা যায়।
(৮) রাষ্ট্রের ব্যয়ভার কমানো ও নাগরিক সুবিধা উন্নতির সাথে বাজার ব্যবস্থার গুরুত্ব আছে।
(৯)করোনা কালে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাজার ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া এখনই শুরু করতে হবে।
আমরা কখনই হতাশাগ্রস্থ বা নিরাশাবাদী নই। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ প্রেমিক জনগণ কখনও হতাশাগ্রস্থ্ হতে পারে না। তাই এই করোনা ভাইরাস থেকে উত্তরণ ও কিছুটা হলেও রেহাই পেতে বাজার ব্যবস্থাসহ গ্রামীন অন্যান্য অবকাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে। তাতে অর্থনীতিও বাঁচবে আমরা জনগণও বাঁচব। চিন্তার শুরু ও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বাস্তব এমন কিছু অবস্থান তৈরী করে যা হয়ত অলৌকিক মনে হয়। লৌকিককে অলৌকিক করাও একনিষ্ঠ কর্ম ও পরিশ্রমের ফল এবং ফসল। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে বাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ও তার শিক্ষা পরবর্তী বড় সমস্যার সহজ সমাধান দিতে পারবে। তাই নীতি নির্ধারকরা এখনই কাজ শুরু করতে পারে।
লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, কলামিস্ট, গবেষক ও লেখক। ইমেইল-bdjdj1984du@gmail.com