কালীগঞ্জ

অস্তিত্ব সংকটে ঝিনাইদহের চিত্রা

অপরূপ সৌন্দর্যের চিত্রা নদী অবৈধ দখল-দূষণ আর নাব্য সংকটের কবলে পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। কুষ্টিয়ার কালিগঙ্গা নদী থেকে চিত্রার উৎপত্তি। সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইলসহ মোট আটটি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ১৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চিত্রার একটি শাখা খুলনার ভৈরবের সঙ্গে অন্যটি নড়াইলের কালিয়ার গাজিরহাটে নবগঙ্গার সঙ্গে মিশেছে। নদীটি বেশি প্রবাহিত হয়েছে ঝিনাইদহ ও নড়াইল জেলার মধ্য দিয়ে। আর এ অংশেই নদীটি সবচেয়ে বেশি দখল-দূষণের শিকার। একসময় চিত্রা নদী খরস্রোতা স্রোতস্বিনী নদী হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন চিত্রা নদীর চিত্র বদলে গেছে। নড়াইল শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া চিত্রা নদী একসময় অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগের ক্ষেত্রে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহার হতো।

একসময় বড় বড় জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার ও নৌকা চলত চিত্রা নদীতে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতেন বণিকরা। এ নদী পথেই বিনাইদহ-যশোর-খুলনায় ব্যবসা করতেন ব্যবসায়ীরা। ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল জেলার কৃষকরাও এ নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন।

জানা যায়, অপরূপ সৌন্দর্য আর শান্ত এ নদীর তীরে নড়াইলের জমিদারি প্রথার গোড়াপত্তন হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে জমিদার পরিবারের সদস্যদের স্নান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ ও নৌভ্রমণের জন্য ঘাট নির্মাণ করা হয়েছিল এ নদীর তীরে। শান্ত নদীর তীরে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান বসে ছবি আঁকতেন। দুঃখের বিষয়, সেসব এখন স্মৃতি। তবে বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়লে এখনো এ নদীতে নৌকাবাইচের আয়োজন করা হয়।

যাইহোক, নড়াইলের ঐতিহ্যের ধারক চিত্রা নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে ধুঁকছে। দখলদাররা প্রতিনিয়ত গ্রাস করে চলেছে চিত্রাকে। নড়াইল অংশে চিত্রার বুকে বহু অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। নদী তীরের জমি খাসজমি দেখিয়ে দখল করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছেন। নদী তীরের বাসা-বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের লাইন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ময়লা-আবর্জনার পাইপের লাইন জুড়ে দেওয়া হয়েছে নদীর সঙ্গে। জানা যায়, ষাটের দশকে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের কারণে কালিগঙ্গা, মাথাভাঙা ও কুমার নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়। এতে কুষ্টিয়ার কাছে উৎসমুখেই বাধাগ্রস্ত হয় চিত্রা নদী। মাগুরা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অংশেও বাঁধ দেওয়ার কারণে চিত্রা নদী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ ছাড়া চিত্রা নদীর ওপর বিভিন্ন স্থানে বহু সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এতে করে নদীটি নাব্য সংকটের মুখে পড়েছে। নাব্য সংকটের কারণে কুষ্টিয়া থেকে মাগুরা পর্যন্ত চিত্রা নদী শুকিয়ে গেছে। অব্যাহত দূষণ আর দখলের কবলে পড়ে নড়াইল অংশেও নদীটি এখন খালে পরিণত হয়েছে! নদীটির ঝিনাইদহ অংশে দখল ও নাব্য সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। চিত্রা নদীর ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ ও কোটচাঁদপুর অংশে ধান ও সবজি চাষ করা হচ্ছে। এ অংশে চিত্রা নদীর গভীরতা একবারে কমে গেছে। বর্ষার সময় সামান্য পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে চিত্রায় পানি থাকে না বললেই চলে।

এককথায়, নির্বিচারে দখল করা হয়েছে চিত্রা নদী। ধীরে ধীরে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করা হচ্ছে নদীটাকে! নদীর বুকে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের কারণে নদীর গতি রোধ করা হয়েছে। যৌবন হারিয়ে চিত্রা আজ মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে! এই নদীর পানির ওপর নির্ভর করে একসময় নদী পাড়ের হাজার হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হতো। নদীর সঙ্গে যুক্ত থাকা বিভিন্ন খাল-বিল পানির অভাবে মরে যাওয়ায় কৃষিতে সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে চর জেগে ওঠে। মিষ্টি পানির অভাবে এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে অসংখ্য প্রজাতির ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু দেশীয় মাছের ভান্ডার। বর্ষাকালে নদীতে পাট জাগ দেওয়ার কারণে নদীর পানিও ব্যাপক মাত্রায় দূষিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া নদীতে বিভিন্ন ক্লিনিক ও হাসপাতালের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। আশেপাশের বিভিন্ন স্থানের পোলট্রি বর্জ্যরে ঠিকানা হচ্ছে এই চিত্রা নদী। একসময় চিত্রা নদীর পানি খাওয়াসহ বাসা-বাড়ির কাজে ব্যবহার করা হতো। নদীপাড়ের মানুষজন নদীতে একসময় গোসল করত। কিন্তু নানাবিধ অত্যাচার ও দূষণের কারণে নদীর পানি পচে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে করে নদীর জীববৈচিত্র্য নষ্টসহ সার্বিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদীর বিভিন্ন স্থান রীতিমতো ডাস্টবিনে পরিণত করা হয়েছে। নদী শুধু একটি নদীই নয়, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষিকাজে পানির জোগান, দেশি মাছের উৎস, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, নদী পথে যোগাযোগসহ সার্বিক পরিবেশ ও জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে নিজেদের স্বার্থে নদ-নদী বাঁচানো সবচেয়ে বেশি দরকার। তাই অবিলম্বে চিত্রা নদী রক্ষায় দরকার প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার পাশাপাশি নদীতে সব ধরনের দূষণের উৎস বন্ধ করতে হবে।

এ ছাড়া নাব্য সংকট মোকাবিলায় নদীটি পরিকল্পিতভাবে খনন করতে হবে। এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে যেটুকু ক্ষীণ স্রোতধারা তথা প্রাণ নিয়ে চিত্রা এখনো প্রবহমান আছে, এভাবে চলতে থাকলে সেটুকুও হয়তো আর টিকে থাকবে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

sadonsarker2005@gmail.com

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button