কালীগঞ্জের নুরুন্নবী একজন রিয়েল ফাইটার
সাবজাল হোসেন, ঝিনাইদহের চোখ-
নুরুন্নবীর বয়স যখন ২ বছর তখন বাবার সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েন। শরীরে আঘাতের চিহ্ণ এতোটাই ছিল যে, তাকে বাঁচাতে চিকিৎসকেরা তার বাম হাতটা কেটে দিয়েছিলেন। বাবা তোয়াব আলী একজন কাঠ শ্রমিক হলেও সে সময় সবকিছু বিক্রি করে তাকে চিকিৎসা করিয়েছিলেন। এরপর থেকে সংসারের অভাব আর কাটেনি। এভাবেই পার হয়ে গেছে ২২টি বছর। এখন বয়সের ভার ও শারীরিক অসুস্থতায় বাবা তেমন পরিশ্রম করতে পারেন না।
বসতভিটার ৫ শতক জমি ছাড়া তাদের কোনো চাষযোগ্য জমি নেই। ফলে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও সংসারের হাল ধরতে হয়েছে তাকে। তিনি ভাড়ায় আলমসাধুতে মালামাল বোঝাই করে এক হাত দিয়েই গ্রামীণ সড়ক দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দূর-দূরান্তে। কথাগুলো ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের নিয়ামতপুর গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী যুবক নুরুন্নবীর।
নুরুন্নবী জানান, বাবা মা আর দুটি বোন মিলে মোট ৫ সদস্যের সংসার। নিজে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। সংসারের ঘানি টানতে বাবার অনেক কষ্ট দেখেছি। তখন নিজের খুব খারাপ লাগতো। তাই ভাবতাম আমার একটা হাত না থাকলেও বাবার সাহায্যকারী হিসেবে আমার কিছু করতে হবে। এই অনুভব থেকেই আর লেখাপড়া করা হয়নি। কিন্ত কোনো ব্যবসা বাণিজ্য করার মতো টাকাও নেই। বাধ্য হয়ে গ্রামের একজনের ইঞ্জিনচালিত আলমসাধু নিয়ে এক হাত দিয়ে চালানো শিখি। প্রথম দিকে ভাবতাম, পারবো না।
তবে প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর সৃষ্টিকর্তা সহায় থাকায় আমি এক হাতেই খুব ভালো নিয়ন্ত্রণে রেখে গাড়ি চালাতে পারছি। তিনি বলেন, নিজেদের কোনো গাড়ি নেই। গ্রামের নয়ন মিয়ার গাড়ি ভাড়াই চালাই। প্রতিদিন খরচ বাদে ৩ শত থেকে সাড়ে ৩ শত টাকা আয় হয়। গাড়ির মালিককে অর্ধেক টাকা দিতে হয়। বাকিটা নিজের থাকে। কিন্ত সে যখন গাড়ি চালায় তখন আমার অন্যের গাড়ি দেখতে হয়। আমি প্রতিবন্ধী বলে প্রথম দিকে কেউ আমার কাছে গাড়ি দিতে সাহস পাননি। এখন সেই ভয় আর কারও মধ্যে নেই।
তিনি আরও জানান, আমি শুধু মালামাল বহনের কাজ করি। কোনো দোকান অথবা আড়ৎ থেকে মালামাল নিয়ে ভাড়ায় যাই। গাড়িতে নিজের কোনো মালামাল উঠাতে হয় না। শ্রমিকেরা এগুলো লোড আনলোড করে থাকে। যে কারণে হাতের জন্য তেমন একটা সমস্যা হয় না। বরং চলার পথে কোনো সময়ে গাড়ি ঘুরাতে বা অসুবিধায় পড়লে আমার হাত নেই দেখে পথচারী বা আশপাশের মানুষ আমাকে সাহায্য করে থাকে। সে কারণে সবসময় মনে করি, পথের মানুষই আমার বড় শক্তি। আবার আমার একটা হাত না থাকায় মানুষ আমার গাড়ি বেশি ভাড়া নেয়।
নুরুন্নবীর বাবা তোয়াব আলী জানান, নুরুন্নবী আমার একমাত্র ছেলে সন্তান। ছোটবেলায় তার বাম হাত হারানোর পর আমি সবসময় চিন্তা করতাম। ভবিষ্যতে কার ওপর আর্থিক নির্ভরশীলতা আনবো। আমি কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে কে ধরবে সংসারের হাল। কিন্ত এখন সে এক হাতেই সংসারের হাল ধরেছে। যা আমি কখনও কল্পনাও করিনি। মালামাল বহনের জন্য একটা ইঞ্জিনচালিত গাড়ি কিনে দিতে পারলে তার একটা স্থায়ী কর্মসংস্থান হতো। কিন্ত আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না।
নিয়ামতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাজু আহম্মেদ রনি লস্কর জানান, নুরুন্নবীর বাড়ি তার পাশের গ্রামেই। সে দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ছেলেটা বেশ ভদ্র ও পরিশ্রমী। একটা হাত না থাকলেও নুরুন্নবী অন্যদের মতো বসে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করে না। বরং দারিদ্রতা রুখতে সে সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে।