কালীগঞ্জে সোনালী আঁশের সোনালী দিন ফেরার ইঙ্গিত
সাবজাল হোসেন, ষ্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহের চোখ-
এক সময় বিশ্ব বাজারে দেশের সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের চাহিদা ছিল আকাশ চুম্বি। কৃষিতে উৎপাদিত পাট ও পাটজাত পন্য সে সময়ে রপ্তানী করে আসতো প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্ত নানাবিধ কারনে বহিঃবিশ্বে পাটের ঐতিহ্য খানিকটা ক্ষতিগ্রস্থ। দাম কম পাওয়ায় কৃষকেরা কমিয়ে দিয়েছে পাটচাষও। ফলে পাটকলগুলোর সার্বিক অবস্থাও নেই আগের মত। ঠিক এমন অবস্থার মধ্যে পাটের ঐতিহ্য বিশ্ব দরবারে ধরে রাখতে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের রঘুনাথপুর গ্রামে স্থাপিত এ্যামাস ফুটওয়ার লিমিটেড নামের একটি কোম্পানী পাট দিয়েই তৈরী করছে পরিবেশ বান্ধব বিশ্ব মানের নানা ডিজাইনের জুতা।
এখান থেকে প্রতিমাসে কমপক্ষে ৩০ হাজার পিয়ার জুতা রপ্তানী করা হচ্ছে স্পেন,ইতালি জার্মানী, ফ্রান্সসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে। পাটের সুতায় হাত ও মেশিনে নকশা করা নানা ডিজাইনের জুতা বিশ্বের সৌখিন মানুষের কাছে চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নত দেশের জুতার ফ্যাশান শোতেও এই জুতা একাধিকবার প্রদর্শিত হয়েছে বলে দাবি প্রস্ততকারী কোম্পানীর। এমন মফস্মল এলাকায় প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর রপ্তানীযোগ্য জুতা তৈরীতে এ এলাকার প্রায় ৫ শতাধিক হতদরিদ্র অসহায় নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। কোম্পানীর কর্তা ব্যক্তিদের ভাষ্য,সরকারীভাবে উদ্যোগ নিয়ে এ পরিবেশবান্ধব জুতার রপ্তানী বাড়ানোর মাধ্যমে পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
সরেজমিনে উপজেলার রায়গ্রাম ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের মাঠের মধ্যে অবস্থিত এ্যামাস ফুটওয়ার কোম্পানীর কারখানায় গেলে দেখা যায়, পাট থেকে তৈরী এক ধরনের সুতা সৌখিন এ জুতা তৈরীতে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে। এছাড়াও রাবার গলিয়ে এখানেই মেশিনের ডাইসে ফেলে তৈরী করা হচ্ছে জুতার নীচের অংশ বা সোল।
একইভাবে নকশা ও সেলাইযোগ্য পাটের সুতা প্রস্তত ছাড়াও বিশেষ কাপড় এখানেই প্রস্তত করা হচ্ছে। এরপর রাবারের সোলের ওপর কাটা কাপড়ের অংশ বসিয়ে পাটের সুতায় হাতে নকশার সেলাই দেয়া হচ্ছে। এ কাজগুলো কারখানায় বসে করছেন এলাকার মহিলারা। আবার জুতা তৈরীর মালামাল মেশিনের প্রাথমিক কাজ শেষ করে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে আশপাশের গ্রামগুলোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলাদের বাড়ি বাড়িতে। তারা গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি কাজ করে পয়সা রোজগার করছেন।
এ্যামাস ফুটওয়ার লিমিডেট এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবাইদুল হক রাসেল জানান,২০১৩ সালে ইষ্টার্ণ ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং বিষয়ে বিবিএ শেষ করে ঢাকায় প্রথম গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেন। এরপর এলাকার মানুষ ও দেশের জন্য কিছু করার চিন্তা মাথায় আনেন।
ভাবনানুসারে ২০১৬ সালের দিকে সরকারী সকল নিয়ম মেনে কালীগঞ্জ উপজেলার যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কের রঘুনাথপুর মাঠের মধ্যে মাত্র ৪৪ শতক জমির ওপর পাটের জুতা তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। গ্রামাঞ্চাল হওয়ায় প্রথম দিকে নানা প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। ২০১৭ সাল থেকে ফ্রান্স, জার্মানী,ইতালি,স্পেনসহ বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর বায়াররা বেশ চাহিদার সাথে এ জুতাগুলো কিনে নিচ্ছেন। এর আগে কোম্পানীর পক্ষ থেকে পাটের তৈরী জুতার বিশ্ব বাজার সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন দেশের মেলায় জুতার স্টল দিয়ে বায়ারদের নজর কাড়া হয়েছে। ২০১৮ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফ্যাশান শো ও মেলায় তাদের তৈরীকৃত সু প্রথম প্রদর্শিত হয় এবং সমাদৃত হয়। ওই বছরেই আমেরিকার লার্স ভেগাস ও ২০১৯ সালে হংকং এ অনুষ্ঠিত মেলায় কোম্পানীর পক্ষ থেকে পাটের তৈরী জুতার স্টল দিয়ে বায়ারদের দৃষ্টি কাড়ার পর পাটের জুতার বিশ্ববাজারে চাহিদা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
তিনি আরও জানান, বর্তমান কোম্পানীতে ৮০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। এছাড়াও এলাকার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৪ শতাধিক নারীকে প্রথমে জুতা তৈরীর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কারখানায় প্রতিদিনের হাজিরা বাদে অন্যরা যারা আছেন তারা বাড়িতে বসেই গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি নির্দেশনা মোতাবেক এই জুতার হাতের কাজ করে থাকেন। কাজ শেষ হলেই কোম্পানীর পক্ষ থেকে আবার জুতাগুলো নিয়ে আসা হয়। তিনি বলেন, বাড়িতে বসে একজন মহিলা গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি কমপক্ষে ৩০ পিয়ার জুতার কাজ করতে পারেন। প্রতি পিয়ারের জন্য দেয়া হয় ৮ টাকা। ফলে তারা বাড়ি বসেই প্রতিদিন ২৮০ থেকে ৩’শ টাকা আয় করতে পারেন। এছাড়াও মহিলাদের মধ্যে যারা কারখানায় কাজ করেন দক্ষতার বিবেচোনায় তাদের বেতন অনেকটা বেশি। আবার যারা কর্মকর্তা আছেন তাদের বেতন ৪০ হাজার পর্যন্ত আছে।
ওবাইদুল হক রাসেল আরও জানান, তার ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত জুতা তিনি ২ থেকে ১৫ ডলার পর্যন্ত দামে বিশ্ব বাজারে বিক্রি করে থাকেন। চাহিদার কারনে ২ ডলারের জুতা বিদেশে ১৫ থেকে ২০ ডলারে পর্যন্ত বিক্রি হয়।
তিনি বলেন,নিজেই বিশ্ববাজারে এই জুতার মার্কেটিং করে থাকেন। সরাসরি বায়ারদের সাথে কথা বলে তাদের মালামাল রফতানি করে থাকেন।
এ্যামাস ফুটওয়ার লিমিটেডের ম্যানেজার মাসুদ রানা জানান, এই কারখানায় তৈরীকৃত জুতা শেষ নামাতে মোট ৬ টি স্তর পার হতে হয়। সোল তৈরি হয় রাবার দিয়ে আর জুতা তৈরি হয় পাট দিয়ে। এখানে মেশিন কাজে লাগানো হলেও জুতা তৈরীর অর্ধেকের বেশি কাজ করা হয় হাতে। পাটের চিকন মসৃন সুতা দিয়ে সেলাই ও নকশা করলে আকর্ষনীয় হয়। তিনি বলেন, প্রতিমাসে তাদের কারখানা থেকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার পিয়ার জুতা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে রফতানি করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান,এই জুতা তৈরীর উপকরণ প্রাকৃতিক রাবার,পাট, বিশেষ ধরনের কাপড় সবই পঁচে মাটিতে মিশে যায় যে কারনে এ জুতা পরিবেশ সম্মত। এই কর্মকর্তা জানান, দেশের আরও কয়েকটি স্থানে পাটের জুতা তৈরী করা হচ্ছে। তবে খুলনা বিভাগে এটাই প্রথম। দেশে পাটের উৎপাদিত জুতা তৈরীর আরও কয়েকটি কারখানা থাকলেও খুলনা বিভাগে এটিই প্রথম।