মুসা মিয়া: সৌম্যকান্ত প্রজ্ঞাবান মানুষ
ঝিনাইদহের চোখ-
লেখক-টোকন ঠাকুর
সূত্র- সাম্প্রতিক দেশকাল
মনীষী-চিন্তক-লেখক আহমদ ছফার সঙ্গে যেদিন আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়, ছফা জানতে চান, ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’
বললাম, ‘ঝিনাইদহ।’
আহমদ ছফা বললেন, ‘তোমাদের এলাকায় তো হত্যা-আত্মহত্যা বেশি।’
বলেছি, ‘জি।’
ছফা জানতে চান, ‘কেন বেশি?’
ঢাকার শাহবাগের আজিজ মার্কেটে ছফা ভাইয়ের একটি বসার ঘর ছিল। কেউ কেউ বলতেন, ছফার টোল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতাম, প্রায় প্রত্যেক দিন ছফা ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। তো প্রথম দিনের আলাপেই ছফা বললেন, ‘তোমাদের অঞ্চল পিছিয়ে পড়েছে ঢাকা থেকে। ওখানে মানুষের কাজের সুযোগ কম, নইলে আত্মহত্যা করে মরার সময়-সুযোগ পাচ্ছে কীভাবে?’
আহমদ ছফা বললেন, ‘ঝিনেদা থেকে ঢাকায় আসতে দুইটা ফেরি লাগে না?’
‘জি লাগে। কামারখালী ফেরিঘাট ও আরিচা ফেরিঘাট।’
আহমদ ছফা বললেন, ‘তাহলে ঝিনেদা থেকে ঢাকায় আসতে কতক্ষণ লাগে?’
বললাম, ‘৯/১০ ঘণ্টা।’
কামারখালী ফেরিঘাট যখন ছিল, তখনকার দিনের যাতায়াতে সময় এরকম-ই লাগত।
এরপর আহমদ ছফা বললেন, ‘ঝিনেদা থেকে কলকাতায় যেতে কতক্ষণ লাগে, জান?’
বললাম, ‘সীমান্তে ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত সময় বাদ দিলে ৫ ঘণ্টার মতো লাগতে পারে।’
আমাদের সেই ছোট বয়সে কত কী স্বপ্ন! প্রেসে যাকে দেখি, তিনি একজন সৌম্যকান্তি চেহারার মানুষ, আলাপের পরেই দেখলাম, তিনি আমাদের ভালোভাবে গ্রহণ করলেন। সাহিত্য নিয়ে আমাদের আবেগকে যে তিনি এত আদর দিয়ে গ্রহণ করবেন, সেটা আগে টের পাইনি। অতএব, ছাপা হতে শুরু করল আমাদের ম্যাগাজিন। আমরাও ঘনঘন যাতায়াত করি কিংশুক প্রেসের অফিসে। এবং জানলাম, সেই প্রজ্ঞাবান সৌম্যকান্ত মানুষটির নাম মো. জাহিদ হোসেন মুসা মিয়া। তার কাছে গেলেই ভালো লাগত, কারণ, আমদের সেই কচি বয়সে সাহিত্য নিয়ে যা বলতাম, আমরা ভাবতাম, তিনি মনে হয় আমাদের কথা আমলে নেবেন না; কিন্তু হতো তার উল্টো। মুসা মিয়ার একটা প্রশ্রয় বরাদ্দ থাকত আমাদের জন্য
আহমদ ছফার অঙ্কটা এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে উঠল, তিনি বললেন, ‘তার মানে ৪৭-এর দেশভাগের আগে তোমাদের অঞ্চলের লোকজন কেন্দ্রে যেত ৫ ঘণ্টায়। কেন্দ্র তখন কলকাতা। তিনশ’ বছর তাই ছিল। কিন্তু দেশভাগের পর ঢাকা যখন কেন্দ্র হয়ে গেল, তখন তোমাদের অঞ্চলের লোকজনকে কেন্দ্রে আসতে লাগে ১০ ঘণ্টা। গত পঞ্চাশ বছরে তোমাদের অঞ্চলের লোক ঢাকায় খুব প্রাসঙ্গিক কারণেই।’
আমি এর আগে কোনোদিন এমন করে ভাবতে পারিনি কিন্তু আমার বাড়ি ঝিনাইদহ শুনেই আহমদ ছফা এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানালেন তার। অনেকবছর ঢাকায় বসবাসের মধ্য দিয়ে আমি ছফা ভাইয়ের কথার বাস্তবতা ধরতে পেরেছি। যে ঝিনাইদহ শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত শীর্ণকায়া নবগঙ্গা নদী, যে ঝিনাইদহ শহরের অন্যতম প্রধান দুটি সড়কের নাম ‘গীতাঞ্জলি সড়ক’ ও ‘অগ্নিবীণা সড়ক’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের নামে অনেক স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান আছে ঢাকা-কলকাতা ও দুই বাংলার অনেক শহরেই; কিন্তু তাদের দুটি বইয়ের নামেই একটি শহরের অন্যতম প্রধান দুটি সড়কÑএমনটি কি আর কোথাও দেখেছি? আমার মনে পড়ে না।
ঝিনাইদহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল। ঐতিহ্যের কিছুই কমতি নেই এখানে। ছোটবেলায় যখন বড় হচ্ছিলাম, যখন আমি ঝিনাইদহের বাইরেই কোথাও যাইনি- কি কি দেখতাম? এখন যখন মাঝে মধ্যেই ঝিনাইদহ যাই, কী কী বদল দেখি? সময় বদলে দিয়ে যায় প্রায় সব কিছুই। সেটাই স্বাভাবিক; কিন্তু বদল হলেও তা কি সব একদম হারিয়ে যায়? আমার তো সবই মনে আছে- ঝিনাইদহে বসে সেই বড় হয়ে উঠবার সময় ঢাকার পত্র-পত্রিকায় ডাকযোগে লেখা পাঠাতাম। হঠাৎ একদিন দেখতাম, একটি কবিতা ছাপা হয়েছে কোনো কাগজে। সে কী আনন্দ আমার! ঝিনেদায় বসে দেখতাম, বাংলাদেশের একমাত্র টেলিভিশন সেন্টার ‘বিটিভি’। ঝিনেদা সরকারি কেশবচন্দ্র কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শহীদুর রহমানের কথা আমার স্মৃতির মধ্যে থেকে যাবে। সাহিত্যের খুঁটিনাটি অনেক কিছুই শিখতাম তার কাছে। তিনি ছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক আজাদ, আবুল কাসেম ফজলুল হক, আহমদ ছফা, আব্দুল মান্নান সৈয়দ-এঁদের বন্ধু। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিশেষ ঘনিষ্ঠ। এরা কেউ ঝিনেদায় গেলে ওখানকার সার্কিট হাউসে না উঠে উঠতেন শহীদুর রহমানের বাসায়। আমি তখন এইসব মানুষদের হয়তো সামনাসামনি প্রথম দেখতে পাই। এখন হয়তো ঢাকার প্রণিধানযোগ্য প্রায় সব পত্র-পত্রিকাতে কত লেখাই লিখি, কত ঈদ সংখ্যায় লিখি, বিশেষ সংখ্যায় লিখি। বইমেলায় বই বের হয়। এখন হয়তো দুনিয়ার শিল্প-সাহিত্য-সিনেমার তত্ত্ব তালাশ করি, কিন্তু একদিন ঝিনাইদহ শহরে বসে এ সবের কিছুই জানতাম না। এখন হয়তো আব্বাস কিওরোস্তমির ছবি দেখি, মাখমালবাফের ছবি দেখি, জাফর পানাহির ছবি দেখি, গঞ্জালেস ইনারিতুর ছবি দেখি, কিম কি ডুকের ছবি দেখি, এদোনিসের কবিতা পড়ি, ওরহান পামুকের লেখা পড়ি বা কুরোসাওয়ার ছবি দেখি কিন্তু ঝিনেদায় বসে, ঝিনেদার প্রেক্ষাগৃহে দেখতাম ঢাকার ছবি। ঝিনেদায় বসে ঢাকা বা কলকাতার ছাপানো বই পড়ি। সেই ঝিনেদা শহরই ছিল এমন একটা দরজা- যার ভেতর দিয়ে আমি পৃথিবীর দিকে হাঁটতে বেরিয়েছি। হাঁটছি।
ঢাকার পত্রিকায় লেখা ছাপা হতো না, যতটা লিখতাম। অবশ্য সে-সব লেখা পরিণতও ছিল না। তবু আবেগে ভেসে যেতাম নবগঙ্গায়। তাই দু-একজন সমমনা বন্ধুকে নিয়ে, হয়তোবা বা অধ্যাপক শহীদুর রহমানের সহযোগিতায় একটি সংকলন ছাপানোর আয়োজন শুরু করি। লেখা জোগাড় করার পর তখন সে-সব ছাপানো হবে কোথায়? ভালো ছাপাখানা কোনটি? আবার ভালো ছাপাখানা হলেও আমাদের চাহিদা পূরণ হবে না, আমাদের কবিতা লেখার আবেগ বুঝবে কিনা, ছাপানোর খরচপাতি কমাবে কিনা- এইসব চিন্তার মধ্যেই আমাদের ভাবনায় আসে ‘কিংশুক প্রেস’-এর নাম। আমরা কয়েকজন দল বেঁধে যাই কিংশুক প্রেসে। আজ লেটার প্রেসের সেই বর্ণমালার কথা মনে পড়ল লিখতে লিখতে। সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের বিপরীত দিকে কিংশুক প্রেস। একদিন যাই কিংশুকে।
আমাদের সেই ছোট বয়সে কত কী স্বপ্ন! প্রেসে যাকে দেখি, তিনি একজন সৌম্যকান্তি চেহারার মানুষ, আলাপের পরেই দেখলাম, তিনি আমাদের ভালোভাবে গ্রহণ করলেন। সাহিত্য নিয়ে আমাদের আবেগকে যে তিনি এত আদর দিয়ে গ্রহণ করবেন, সেটা আগে টের পাইনি। অতএব, ছাপা হতে শুরু করল আমাদের ম্যাগাজিন। আমরাও ঘনঘন যাতায়াত করি কিংশুক প্রেসের অফিসে। এবং জানলাম, সেই প্রজ্ঞাবান সৌম্যকান্ত মানুষটির নাম মো. জাহিদ হোসেন মুসা মিয়া। তার কাছে গেলেই ভালো লাগত, কারণ, আমদের সেই কচি বয়সে সাহিত্য নিয়ে যা বলতাম, আমরা ভাবতাম, তিনি মনে হয় আমাদের কথা আমলে নেবেন না; কিন্তু হতো তার উল্টো। মুসা মিয়ার একটা প্রশ্রয় বরাদ্দ থাকত আমাদের জন্য। তারপর হয়তো ম্যাগাজিন ছাপা হয়ে গেল। আমরা প্রেসে কিছু টাকা পরিশোধ করে ম্যাগাজিন নিয়ে যেতাম। সেই ম্যাগাজিন বিক্রি করে কি আর টাকা পাওয়া সম্ভব? নামকাওয়াস্তে যারা বাকিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, তারা ম্যাগাজিন হাতে পাওয়ার পরও যখন আর টাকা পরিশোধ করে না, কী করব আমরা?
কিছুদিন হয়তো বঙ্গবন্ধু সড়কে চলাফেরা কমিয়ে দিলাম। যাতে মুসা মিয়ার সামনে না পড়ি। আবার হয়তো একদিন চোখে পড়ে গেছি, কাচুমাচু করে সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছি কিন্তু তিনি নিজেই হয়তো তখন বলতেন, ‘জানি। এরকম হয়। এরপর আর ম্যাগাজিন বের করবা না তোমরা?’
বলেছি, ‘আগের সংখ্যার টাকাই তো পরিশোধ হয়নি।’
তিনি বললেন, ‘সে তো জানিই। আবার লেখা সংগ্রহ করে চলে আসো একদিন। ম্যাগাজিন ছাপাও। কবিতা তো ছাপতে হবে।’
এই হচ্ছেন কিংশুক প্রেসের মো. জাহিদ হোসেন মুসা। আমার ছোটবেলায় ঝিনেদা শহরে দেখা সবচেয়ে সৌম্যকান্তির একজন মানুষ, যার সেই দিনের প্রশ্রয়টুকু আমার কাজে লেগেছে, এগিয়ে দিয়েছে। তখন সেই ছোট বয়সে তো আর তার সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারিনি, তিনি কে? কী তার চিন্তা, রাজনৈতিক চেতনা! কারণ, কলেজের দিন পার করে আমি ঝিনেদার বাইরে চলে আসি। মানুষ আসতে আসতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেমন পৃথিবীর দিকে চলে যায়; কিন্তু বাড়িটাই তার আরেক পৃথিবী। আমার সেই আরেক পৃথিবী হচ্ছে ছোট্ট শহর ঝিনাইদহ, যেখানে আমার মা-বাবা-ভাইবোন থাকে। যেখানে আমার ছোটবেলার প্রিয় মানুষেরা থাকে। যেমন আছেন কিংশুক প্রেসের মালিক মো. জাহিদ হোসেন মুসা মিয়া; কিন্তু তার বিস্তারিত পরিচয় জেনেছি আরও পরে, তিনি ভাষাসৈনিক। ঝিনাইদহের প্রবীণ রাজনীতিবিদ মো. জাহিদ হোসেন মুসা মিয়া গত ১৭ নভেম্বর রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। তিনি ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময়ে বাংলা ভাষার দাবিতে সোচ্চার হন এবং এ আন্দোলনে যশোর অঞ্চলে নিজেকে যুক্ত করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে ঝিনাইদহ মহকুমার ন্যাপ সভাপতির দায়িত্বে থাকার সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন।
ঝিনাইদহ অঞ্চলের মানুষের জন্য তিনি অনেক করেছেন। এরকম মানুষ এখন সমাজে বিরল, যেমনটি ছিলেন মুসা মিয়া। দিন যাবে, দিন বদলাবে; কিন্তু এমন মানুষ আর সহজে মিলবে না। ঝিনেদার মানুষ তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে, মনে রাখবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মুসা মিয়ার কাছে কৃতজ্ঞ থেকে যাব আজীবন। ঋণ পরিশোধ করতে পারব না কখনোই। মুসা মিয়ার সেই সৌম্যকান্ত প্রজ্ঞাবান মুখটা আমার মনে থেকে যাবে।