ধর্ম ও জীবন

যে সাহাবিকে বলা হতো জীবিত শহীদ!

এ পাহাড়সারিকে পেছনে রেখেই সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওহুদ যুদ্ধ। ছবিতে খোলা চত্বরের বামে দেয়ালঘেরা প্রশস্ত কবরস্থানে শুয়ে আছেন এ যুদ্ধের মহান শহীদরা। যাদের পুরোভাগে রয়েছেন সাইয়েদুশ শুহাদা বা শহীদদের নেতা নবীজি (সা.) এর চাচা হামজা (রা.)। তার স্মৃতি অমর করে রাখতে এর ডানে নির্মিত হয়েছে মসজিদে সাইয়েদুশ শুহাদা। মসজিদের সামনে খোলা স্থানেই সংঘটিত হয়েছিল যুদ্ধ। তার ডানেই রয়েছে ঐতিহাসিক রুমাত পাহাড়। চলতি বছর হজের সফরে সৌদি আরবের মদিনা তাইয়েবার অদূরে ওহুদ প্রান্তর থেকে ছবিটি তুলেছেন আলী হাসান তৈয়ব

খুঁজে দেখা গেল তিনি অজ্ঞান হয়ে একটি গর্তে পড়ে আছেন। তার একটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায় এবং সারা দেহে তরবারি, তীর ও বর্শার সত্তরটির বেশি আঘাত। পরবর্তীকালে রাসুল (সা.) তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘যদি কেউ কোনো শহীদকে জীবিত চলাফেরা করতে দেখতে চায়, সে যেন তালহা বিন উবাইদুল্লাকে দেখে।’ (উসদুল গাবাহ :  ১/৫৪৪)। এ কারণে তাকে জীবিত শহীদ বলা হতো​

তিনি তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.)। ওহুদের যুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন ওহুদ যুদ্ধের নায়ক। কিছু সংখ্যক মুসলমানের ভুলে মুসলিম বাহিনী যখন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন যে ক’জন সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে ঘিরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.) তাদের অন্যতম। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সাহাবি ব্যতীত প্রায় সবাই রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। রাসুল (সা.) পাহাড়ের একটি চূড়ায় উঠলেন, এমন সময় একদল শত্রু সৈন্য তাঁকে ঘিরে ফেলল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘যে এদের হটিয়ে দিতে পারবে সে জান্নাতে আমার সাথী হবে।’ তালহা (রা.) বললেন, আমি যাব ইয়া রাসুলাল্লাহ। নবীজি বললেন, না, তুমি থাক। একজন আনসারি সাহাবি বললেন, আমি যাব। নবীজি বললেন, হ্যাঁ, যাও। তিনি গেলেন এবং মুশরিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। নবীজি আরেকজনকে পাঠাতে চাইলে তালহা (রা.) এবারও যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। নবীজি তাকে থামিয়ে আরেকজনকে অনুমতি দিলেন। এভাবে একজন একজন করে যখন সবাই শাহাদতবরণ করলেন, রাসুল (সা.) তালহাকে বললেন, এবার তুমি যাও। তালহা (রা.) আক্রমণ চালালেন। এদিকে রাসুল (সা.) আহত হলেন। তাঁর দাঁত মোবারক শহীদ হলো এবং তিনি রক্তাক্ত হলেন। এমতাবস্থায় তালহা (রা.) বেপরোয়া হয়ে মুশরিকদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের একটু দূরে তাড়িয়ে দেন, আবার রাসুলের কাছে ছুটে এসে তাঁকে কাঁধে করে পাহাড়ের দিকে উঠতে থাকেন। তাঁকে এক স্থানে রেখে আবার কাফেরদের মোকাবেলা করেন। এভাবে তিনি সেদিন জীবন বাজি রেখে একাকি কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। যুদ্ধ শেষে সাহাবিরা রাসুলের কাছে ফিরে এসে শুশ্রƒষা করতে চাইলে নবীজি বললেন, ‘আমাকে ছাড়ো, তোমাদের ভাই তালহাকে দেখ।’
খুঁজে দেখা গেল তিনি অজ্ঞান হয়ে একটি গর্তে পড়ে আছেন। তার একটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায় এবং সারা দেহে তরবারি, তীর ও বর্শার সত্তরটির বেশি আঘাত। পরবর্তীকালে রাসুল (সা.) তার সম্পর্কে বলেছেন, ‘যদি কেউ কোনো শহীদকে জীবিত চলাফেরা করতে দেখতে চায়, সে যেন তালহা বিন উবাইদুল্লাকে দেখে।’ (উসদুল গাবাহ :  ১/৫৪৪)। এ কারণে তাকে জীবিত শহীদ বলা হতো। আবুবকর সিদ্দিক (রা.) ওহুদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন, ‘সে দিনটির সবটুকুই তালহার।’ রাসুল (সা.) তার প্রতি খুশি হয়ে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেন। তিনি ছিলেন ‘আশারায়ে মুবাশশারা’ তথা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ সাহাবির অন্যতম।
ইসলাম গ্রহণ ও ঈমানি পরীক্ষা
তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.) ইসলামের সূচনাপর্বেই মাত্র পনের বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ। তিনি তখন কোরাইশদের বাণিজ্যিক কাফেলার সঙ্গে সিরিয়ায়। বসরার বাজারে ঘোরাফেরা করছেন। এমন সময় শুনতে পেলেন এক খ্রিস্টান পাদ্রি বলছে, এখানে কি মক্কার কোনো লোক এসেছ? তালহা এগিয়ে গেলেন। বললেন, আমি মক্কা থেকে এসেছি। পাদরি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কি আহমদ আত্মপ্রকাশ করেছে? বললেন, কোন আহমদ? পাদরি বলল, ‘আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র। তাঁর আত্মপ্রকাশের সময় হয়েছে এবং যে মাসে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন, এটা সেই মাস। তিনি হবেন আখেরি নবী। যুবক, তোমার তাড়াতারি তাঁর কাছে যাওয়া উচিত।’ তালহা বলেন, তার এ কথা আমার অন্তরে দারুণ প্রভাব সৃষ্টি করল। আমি কাফেলা ফেলে রেখেই বাহনে চড়লাম। মক্কায় পৌঁছে লোকদের জিজ্ঞেস করলাম, আমার যাওয়ার পর মক্কায় নতুন কিছু ঘটেছে কি? তারা বলল, হ্যাঁ, আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ নিজেকে নবী দাবি করেছে এবং আবু কুহাফার ছেলে আবুবকর তার অনুসারী হয়েছে। তালহা (রা.) আবুবকর সিদ্দিকের কাছে গিয়ে ঘটনার সত্যতা জিজ্ঞেস করলেন। আবুবকর (রা.) বললেন, যা শুনেছ তা সত্য। অতঃপর তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তালহা (রা.) তখন খ্রিস্টান পাদরির ঘটনা সিদ্দিকে আকবরের কাছে খুলে বললেন। আবুবকর (রা.) তাকে সঙ্গে করে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি নবীজির হাতে কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যান। পাদরির ঘটনা নবীজিকে বিস্তারিত শোনান। শুনে তিনি দারুণ খুশি হন।
তালহা (রা.) এর ইসলাম গ্রহণে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট হয়েছে তার মা। তার বাসনা ছিল, ছেলে গোত্রের নেতা হবে। তাই তিনি কোনোভাবেই ছেলের ইসলাম গ্রহণ মেনে নিতে পারেননি। গোত্রের লোকদের দিয়ে ভয়-ভীতি দেখানো হলো। কিন্তু তালহা (রা.) স্বীয় ঈমানে পাহাড়ের মতো দৃঢ়তা দেখালেন। অবশেষে তারা বেছে নিল নির্যাতনের পথ। মাসুদ ইবনে খারাশ বলেন, একদিন আমি সাফা-মারওয়ার মাঝখানে দৌড়াচ্ছি, এমন সময় লক্ষ্য করলাম একদল লোক হাত বাঁধা একটি যুবককে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তারা তাকে উপুড় করে শুইয়ে বেদম প্রহার করতে লাগল। তাদের পেছনে একজন বৃদ্ধ মহিলা চেঁচিয়ে গালাগাল করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেটির এ অবস্থা কেন? তারা বলল, এ হচ্ছে তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ। পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বনি হাশিমের সেই লোকটির অনুসারী হয়েছে। বৃদ্ধ মহিলা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলল, ইনি হচ্ছেন যুবকের মা ‘সাবা বিনতুল হাদরামি’। এভাবে তিনি দীর্ঘ তেরোটি বছর আপনজন ও কোরাইশদের অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
নবীজির সঙ্গে জিহাদে অংশগ্রহণ
তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.) বদরের যুদ্ধ ব্যতীত অন্যসব যুদ্ধে নবীজির সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন। অবশ্য তিনি বদর যুদ্ধেও পরোক্ষভাবে শামিল ছিলেন। কারণ, নবীজি (সা.) তাকে এবং সাঈদ ইবনে যায়েদকে কোরাইশদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য সিরিয়ার দিকে প্রেরণ করেছিলেন। নবীজি তাদের গনিমতের ভাগ দিয়েছেন। এ কারণে তারা বদরি হিসেবে গণ্য। উহুদের যুদ্ধে তিনি বীরত্ব ও সাহসিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। এ জন্য তাকে ওহুদের সাকার তথা ওহুদযুদ্ধের বাজপাখি বলা হয়। খন্দক, খায়বার, বাইয়াতে রিদওয়ান, মুতাসহ সব অভিযানেই তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। মক্কা বিজয়ের দিন মুহাজিরদের যে ক্ষুদ্র দলটির সঙ্গে রাসুল (সা.) মক্কায় প্রবেশ করেন, তালহা (রা.) ছিলেন সেই দলে এবং তিনি নবীজির সঙ্গে পবিত্র কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। বিদায় হজের সফরেও তিনি নবীজির সঙ্গী ছিলেন।
খোলাফাদের দৃষ্টিতে তালহা (রা.)
আবুবকর (রা.) এর খেলাফতকালে তিনি ছিলেন তার বিশেষ উপদেষ্টা। চিন্তা, পরামর্শ ও কাজের মাধ্যমে তিনি তাকে সহযোগিতা করতেন। রাসুল (সা.) এর ওফাতের পর অনেক মুসলমান জাকাত দিতে অস্বীকার করলে আবুবকর তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। ওই সময় অনেক সাহাবি তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করার জন্য খলিফাকে পরামর্শ দেন। কিন্তু তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.) স্পষ্ট বলে দেন, ‘যে দ্বীনে জাকাত থাকবে না তা সত্য ও সঠিক হতে পারে না।’
আবুবকর (রা.) পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে তালহাকে ডেকে বললেন, ‘ওমরকে স্থলাভিষিক্ত করার ব্যাপারে আপনার মতামত কী?’ তিনি বললেন, তার স্বভাবে কিছুটা কঠোরতা আছে। আবু ববকর বললেন, তার ওপর যখন খেলাফতের গুরুদায়িত্ব এসে পড়বে তখন তিনি নরম হয়ে যাবেন। তালহা বললেন, তার গুণাবলি ও যোগ্যতা যে সবার চেয়ে বেশিÑ এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই। তার স্বভাবের একটি দিক সম্পর্কে আমার যা প্রতিক্রিয়া তা বলতে কার্পণ্য করিনি।
হিজরি ১৩ সনে ওমর (রা.) খলিফা হলেন। তিনিও তালহা (রা.) কে যথোপযুক্ত মর্যাদা দিতেন এবং তার পরামর্শ গ্রহণ করতেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় ওমর (রা.) পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য ৬ সদস্যের যে শূরা গঠন করে যান তাদের মধ্যে তালহাও ছিলেন।
ওসমান (রা.) চক্রান্তকারীদের হাতে শহীদ হলে মুসলিম উম্মাহর একটি অংশ এই হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তালহা, যোবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) মদিনা থেকে মক্কায় গিয়ে আয়েশা (রা.) এর সঙ্গে মিলিত হলেন। তারা বসরার উপকণ্ঠে আলী বাহিনীর মুখোমুখি হন। কা’কা ইবনে আমরের মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হলো। আলী, উম্মুল মোমিনিন আয়শা, তালহা ও যোবাইর (রা.) সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছলেন। উভয় পক্ষের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস। কিন্তু ইহুদি বংশোদ্ভূত ইবনে সাবার লোকেরা এতে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মূলত তারাই ছিল ওসমানের হত্যাকারী। তারা আলীর সেনাবাহিনীর মধ্যে গা ঢাকা দিয়েছিল। শান্তি চুক্তির সিদ্ধান্ত হওয়ায় তারা নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বুনল। ইবনে সাবা বলল, এই মীমাংসা বাস্তবায়িত হলে আমাদের কোনো আশ্রয়স্থল থাকবে না। কাজেই রাতের অন্ধকারেই তোমরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে উভয় পক্ষের ক্যাম্পে আক্রমণ কর। এতে উভয় পক্ষ মনে করবে অপর পক্ষ আক্রমণ করেছে। তৃতীয় পক্ষের আক্রমণের কথা কল্পনায়ও আনবে না। ইবনে সাবার চক্রান্ত সফল হলো। সকাল হতে না হতেই একপক্ষের ত্রিশ হাজার এবং অপর পক্ষের বিশ হাজার সৈন্যের মধ্যে তুমুল লড়াই বেঁধে গেল। ইতিহাসে এ লড়াই ‘জঙ্গে জামাল’ নামে খ্যাত। যুদ্ধের সূচনালগ্নে সাবায়িদের নিক্ষিপ্ত একটি তীর তালহার পায়ে বিদ্ধ হয়। এই আঘাতেই তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। বসরায় তাকে দাফন করা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button