জানা-অজানা

৪ মিনিটেই জমির আরএস খতিয়ান !!

#ঝিনাইদহের চোখঃ

আগে জমির বিভিন্ন রেকর্ড যেমন—এসএ, সিএস, বিআরএস নকল/পরচা/খতিয়ান/সার্টিফায়েড কপি অনলাইনে আবেদন করে সপ্তাহখানেক পর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে পাওয়া যেত। এবার যেখান থেকে খুশি, ইচ্ছামতো সময়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মাত্র ৪ মিনিটেই পাওয়া যাবে জমির আরএস খতিয়ান। সম্প্রতি অনলাইনেই এই সেবা চালু হয়েছে।

খতিয়ান কী?

খতিয়ান জমির পরিচিতির এক প্রকার দলিল। সরকারিভাবে জরিপকালে জরিপ কর্মচারী দ্বারা জমিজমার বিবরণসংবলিত সরকারি দলিলই ‘খতিয়ান’ নামে পরিচিত। খতিয়ান মানেই মৌজার দাগ অনুসারে ভূমির মালিকের নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, মালিকানার বিবরণ, জমির বিবরণ, মৌজা নম্বর, মৌজার ক্রমিক নম্বর (জেএল নম্বর), সীমানা, জমির শ্রেণি, দখলকারীর নাম, অংশ প্রভৃতির একটি সুস্পষ্ট হিসাব। যখন একটি পৃথক কাগজে খতিয়ানের অনুলিপি তৈরি করা হয়, তখন সেটিকে পরচা বলে।

খতিয়ানের প্রয়োজনীয়তা

খতিয়ান জমির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। জমি কেনার সময় ক্রেতাকে অবশ্যই জরিপের মাধ্যমে প্রণীত খতিয়ান ও নকশা যাচাই করতে হবে; জমির মৌজা, খতিয়ান ও দাগ নম্বর, দাগে জমির পরিমাণ জানতে হবে। পরচা যাচাই করে দেখতে হবে। শুধু জমি ক্রয়-বিক্রয়ই নয়, এর সঙ্গে জমি রক্ষণাবেক্ষণ এবং দখলে রাখার ক্ষেত্রেও খতিয়ানের গুরুত্ব রয়েছে। খতিয়ান বা পরচায় কোনো রকম সমস্যা মালিকানা, জমি ক্রয়-বিক্রয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এতে কোনো সমস্যা থাকলে তা ঠিক করে নিতে হবে। মালিকানা নির্ধারণের জন্য জমির পরিচিতির দরকার হয়। বর্তমানে মালিকানা নির্ধারণে এর গুরুত্ব বেশি। খতিয়ানে শুধু মালিকের নামই নয়; বরং এর সঙ্গে বিক্রেতা ক্রয়সূত্রে মালিক হলে তাঁর মালিকানার যোগসূত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। বিক্রেতা উত্তরাধিকারসূত্রে মালিক হলে পূর্বমালিকানা ক্রমান্বয়ে মেলাতে হবে। যদিও শুধু খতিয়ান দেখেই মালিকানা নিশ্চিত হওয়া যাবে না। এর জন্য হস্তান্তর দলিল, দখল, দাখিলা—সব কিছুর সমন্বয় প্রয়োজন। এ ছাড়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায়, দখলের প্রমাণ, হস্তান্তর, বিবাদ নিষ্পত্তি সহজকরণ, জমির দাগ, অংশ, হিসসা, শ্রেণি জানার জন্য ভূমি মালিকানার ইতিহাস সংরক্ষণ, জমি বেচাকেনার সময় যাচাই ইত্যাদি কাজে জমির খতিয়ানের প্রয়োজন হয়।

খতিয়ান তোলার আগের পদ্ধতি

আগে জমির খতিয়ান বা পরচা তুলতে সবাইকে জেলা সদরের রেকর্ডরুম থেকে আবেদন করে হাতে লেখা খতিয়ান তুলতে প্রায় এক থেকে দুই মাস সময় লেগে যেত। অল্পদিনে খতিয়ান বের করে দেওয়ার নামে সেখানে দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ছিল। সাধারণ জনগণের কাছ থেকে অবৈধভাবে কয়েক শ থেকে হাজার টাকা হাতিয়ে নিত তারা। এসব ভোগান্তি থেকে রেহাই দিতে ২০১১ সালে যশোরের তৎকালীন সহকারী জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান অনলাইনে আবেদনে জমির পরচা সরবরাহ করার উদ্যোগ নেন। পাইলট প্রকল্প শেষে ওই বছরের নভেম্বরে দেশের বাকি ৬৩টি জেলায় কাউন্টার, সার্ভাররুম সেটআপের মাধ্যমে অনলাইনে জমির পরচা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সে ক্ষেত্রেও আবেদনকারীকে জেলা সদরে যেতে হতো। এর পরের বছর ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে একইভাবে জমির পরচা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সারা দেশ থেকে গ্রাহকদের মতামত নিয়ে ২০১৩ সালে পাইলট প্রকল্প হিসেবে সিরাজগঞ্জের ৩০টি ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রে ই-ল্যান্ড রেকর্ড সার্ভিস (ইএলআরএস) সিস্টেম চালু করা হয়। আশানুরূপ সাড়া পাওয়ায় পরবর্তীকালে ভূমি মন্ত্রণালয় সারা দেশের সব ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে এই সেবা চালু করে।

আরএস-কে পদ্ধতি চালু

ইএলআরএস সিস্টেমে ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকে আবেদন করা গেলেও তাত্ক্ষণিকভাবে খতিয়ান বা পরচা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। সপ্তাহখানেক অপেক্ষার পর ওই তথ্যসেবা কেন্দ্র থেকেই সেটি গ্রহণ করতে হতো। এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় খতিয়ানের কপি প্রাপ্তিতে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা পরিহার, সময়, খরচ ও যাতায়াতের ভোগান্তি হ্রাস, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস, ভূমিসংক্রান্ত সেবা আরো স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা, আরএস খতিয়ানগুলোকে সর্বসাধারণের ব্যবহার উপযোগী করা এবং দেশের সব খতিয়ানের তথ্য একটি প্ল্যাটফরমে আনার জন্য আরএস খতিয়ান সংক্ষেপে ‘আরএস-কে’ পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য কয়েক বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের সহায়তায় আরএস খতিয়ানের ডিজিটালাইজড সংস্করণ তৈরির কাজ চলে আসছিল। সর্বশেষ এ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘হাতের মুঠোয় খতিয়ান’ স্লোগানে সচিবালয়ে আরএস খতিয়ান অনলাইনে অবমুক্তকরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। এর ফলে land.gov.bd বা rsk.land.gov.bd বা www.minland.gov.bd বা আরএস খতিয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে খতিয়ানের কপি সংগ্রহ করার সুবিধা উন্মুক্ত হয়।

দেশে প্রায় ৬১ হাজার ৫০০ (তিন পার্বত্য জেলা বাদে) মৌজা রয়েছে। এর মধ্যে ৪১ হাজার মৌজার জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় ৩২ হাজার মৌজার জরিপে প্রকাশিত এক কোটি ৪৬ লাখ আরএস (১৯৬৫ সাল থেকে চলমান জরিপে প্রস্তুত করা খতিয়ান) খতিয়ানের তথ্য অনলাইনে পাওয়ার সুযোগ করা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাকি খতিয়ানগুলো ক্রমান্বয়ে যুক্ত হতে থাকবে। জরিপ কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং জরিপ শেষ হয়েছে এমন খতিয়ানগুলো পর্যায়ক্রমে আপলোড করা হবে। জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর চূড়ান্তভাবে গেজেট প্রকাশিত খতিয়ানও এসব লিংকে আপলোড করা হবে বলে জানানো হয়। ফলে এখন থেকে আর খতিয়ানের অনলাইন কিংবা সার্টিফায়েড কপি পেতে ভূমি অফিসে কিংবা ডিসি অফিসে দৌড়ানোর প্রয়োজন হবে না।

যেভাবে পাবেন আরএস-কে সেবা

অনলাইনে আরএস খতিয়ান পেতে চাইলে আগ্রহীকে প্রথমে https://www.land.gov.bd/pages/R-S-Khotian অথবা এই উদ্যোগের মূল ওয়েবসাইট ত্ংশ.ষধহফ.মড়া.নফ ওয়েবসাইটে যেতে হবে। মূল ওয়েবসাইটের হোম পেইজের মাঝামাঝি লেখা নাগরিক কর্নারে ক্লিক করতে হবে। এরপর খতিয়ান ও দাগের তথ্য অনুসন্ধানের অনলাইন আবেদন পেইজ আসবে। সেখানে ড্রপডাউনের মাধ্যমে নির্ধারিত বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও মৌজা বাছাই করতে হবে। এরপর খতিয়ান নম্বর, বা দাগ নম্বর বা মালিকানার নাম কিংবা পিতা বা স্বামীর নাম দিতে হবে। এর যেকোনো একটি দেওয়ার পর নিরাপত্তার জন্য সেখানে থাকা ‘যোগফল প্রদান করুন’ ঘরটি পূরণ করতে হবে। তারপর ‘নিচে খুঁজুন’ বাটনটি চাপতে হবে। লোডিংয়ের মাধ্যমে নিচে দ্রুততম সময়ে মালিক, অকৃষি প্রজা বা ইজারাদারের তথ্য, দাগের সংখ্যা ও মোট জমির পরিমাণ দেখাবে। সেখানে নিচে ‘এই খতিয়ানের সার্টিফায়েড কপির জন্য আবেদন করুন’ কিংবা ‘অনলাইন কপির জন্য আবেদন করুন’ নামে দুটি লিংক বাটন আছে।

সেবাগ্রহীতা আরএস খতিয়ানের সার্টিফায়েড কপি (হার্ড কপি) নিতে চাইলে প্রথম বাটনটি চাপতে হবে। তাহলে নতুন একটি পেইজ আসবে। সেখানে সাধারণ নাকি জরুরি ডেলিভারি, ডেলিভারির মাধ্যম অফিস কাউন্টার নাকি ডাকযোগে সেটি নির্বাচন করে দিতে হবে। এরপর নির্ধারিত ঘরে নাম, মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, ই-মেইল, ঠিকানা বা পোস্টাল অ্যাড্রেস এবং যোগফল প্রদান—ঘরগুলো পূরণ করতে হবে। সাধারণ ডেলিভারিতে পাঁচ দিন এবং জরুরি ডেলিভারিতে তিন দিন সময় লাগবে। অফিস কাউন্টার থেকে নিলে ডেলিভারি চার্জ প্রযোজ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে ইউক্যাশের মাধ্যমে কোর্ট ফি যথাক্রমে ২২ অথবা ২৭ টাকা দিতে হবে। আর ডাকঘরের মাধ্যমে নিলে ডেলিভারি চার্জসহ ইউক্যাশের মাধ্যমে যথাক্রমে সর্বমোট ৭২ টাকা অথবা ৭৭ টাকা পরিশোধ করতে হবে। তাই ইউক্যাশ নম্বর লেখা ঘরে সেবাগ্রহীতা যে ইউক্যাশ নম্বর থেকে ফি পরিশোধ করবেন, সেটি দিতে হবে। এরপর নিচে ‘টাকা পরিশোধ করুন’ বাটনে ক্লিক করতে হবে। টাকা পরিশোধ হয়ে গেলে আবেদন অনুযায়ী অফিস কাউন্টার কিংবা প্রত্যাশিত ঠিকানায় ডাকযোগে নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে আরএস খতিয়ানের সার্টিফায়েড কপি সরবরাহ করা হবে। অন্যদিকে অনলাইন কপি নিতে চাইলে ‘অনলাইন কপির জন্য আবেদন করুন’ বাটনে ক্লিক করতে হবে। পরবর্তী পেইজে উপরোক্ত নিয়মে নাম, মোবাইল নম্বর ও যোগফল প্রদান ঘর বাধ্যতামূলকভাবে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, ই-মেইল, ঠিকানা ঘরগুলো প্রযোজ্য হলে পূরণ করতে হবে। এরপর নিচে প্রিন্ট বাটন ক্লিক করলে নতুন পেইজে আরএস খতিয়ানের পিডিএফ ওপেন হবে। সেটি প্রয়োজনে ডাউনলোড বা প্রিন্ট করা যাবে।

অ্যাপেও পাওয়া যাবে সেবা

স্মার্টফোনে অ্যাপের মাধ্যমেও সেবাটি দেওয়ার জন্য প্লেস্টোরে ‘আরএস খতিয়ান’ নামে একটি অ্যাপ উন্মুক্ত করা হয়েছে।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.softbdltd.rskলিংক থেকে অ্যাপটি ডাউনলোড করা যাবে। ডাউনলোড ও ইনস্টল সম্পন্ন হলে অ্যাপটি ওপেন করতে হবে। এরপর ওয়েবসাইটের মতোই এই অ্যাপেও একইভাবে আবেদনের মাধ্যমে সেবা পাওয়া যাবে।

আছে ট্র্যাকিং সুবিধাও

যারা সার্টিফায়েড কপির জন্য আবেদন করবেন তাঁরা https://www.land.gov.bd/pages/R-S-Khotian লিংক কিংবা অ্যাপের মাধ্যমে তাঁদের আবেদন ট্র্যাকিং করতে পারবেন। এ জন্য ট্র্যাকিং বক্সের অধীন আবেদন আইডি, মোবাইল নম্বর এবং যোগফল প্রদান করুন ঘরগুলো পূরণ করে খুঁজুন বাটনে ক্লিক করতে হবে। তাহলে ওই আবেদনের বর্তমান অবস্থা জানা যাবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button