ঝিনাইদহে ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত যাবজ্জীবন কারাভোগের সঙ্গী রাজা
ঝিনাইদহের চোখ-
রাজা আর যাদব দুটি কবুতরের নাম। তাদের জন্ম যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে। ওই কারাগারে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত আসামি ছিলেন মিজানুর রহমান (৪৭) দীর্ঘ সময় ধরে। কারাবন্দী জীবনে মিজানুরের সঙ্গী ছিল কারাগারের একঝাঁক কবুতর। তবে এর মধ্যে রাজা আর যাদবের সঙ্গে যেন মিজানুরের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মিজানুর মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তখন তাঁর সঙ্গে রাজা আর যাদবও চলে আসে কারাগার থেকে বাড়িতে। এ যেন এক ভালোবাসার অনান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করল যাবজ্জীবন কারাভোগের সঙ্গী কবুরত রাজাবাবু
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হরিশংকরপুর ইউনিয়নের বাকড়ি গ্রামের মৃত আনোয়ার হোসেনের চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মিজানুর রহমান।
সরোজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, একটি হত্যা মামলায় আসামি হয়েছিলেন তিনি। মামলার রায়ে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। রায় হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ২৫ বছর। এরপর দীর্ঘ ২২ বছর ১০ মাস পর ২ জুন তিনি মুক্তি পেয়েছেন। কারাজীবনে তিনি খুলনা, ঝিনাইদহ, যশোর ও ঢাকা কারাগারে থেকেছেন। সর্বশেষ তিনি মুক্তি পান যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। এরপর থেকে দুই কবুতর নিয়ে মিজানুর নতুন জীবন শুরু করেন। মিজানুর রহমান যে ঘরে ঘুমান, সেই ঘরেই কবুতরগুলো থাকত। তবে অপরিচিত জায়গা হবার কারনে ৭ জুন যাদব উড়তে গিয়ে ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে কবুতরটি মারা যায়। এ মৃত্যুতে মিজানুরসহ তার পরিবারের লোকজন খুব কষ্ট পেয়েছেন। সঙ্গীর মৃত্যুতে রাজাও দুই দিন কিছইু খায়নি।
আরো জানা যায়, রাজাবাবু একাই ওই বাড়িতে থাকেন। গম ছাড়া সে কিছু খায় না। প্রতিদিন তাকে গোসল করাতে হয়। এবং একদিন পরপর স্যাম্পু দিয়ে গোসল দিতে হয়। অন্য কবুতর তাদের জন্য বানানো ঘরে থাকলেও রাজাবাবু থাকে মিজুনুরের শোবার ঘরে লাইফবয় সাবানের উপর বিছানায়। বড় ষ্ট্যান্ড ফ্যানের বাতাস সে খুবই পছন্দ করে।
মিজানুরের ছোটভাই রেজাউল করিম বলেন, দেশীয় প্রজাতির কবুতর রাজা। তাকে মগে করে পানি খাওয়াতে হয়। এমনকি সে নিজে নিজে খায়ওনা। তাকে মুখে তুলে খাওয়াতে হয়। বাড়ীতে দেশীয় প্রজাতির আরো প্রায় ৫০টির অধিক কুবতর থাকলেও সে আলাদা থাকে। সারাদিনই সে কারো না কারো ঘাড়ে, কোলে, হাতের উপর এমনকি মাথায় চড়ে দিন পার করে। তাকে পেয়ে আমরা সবাই খুশি। মানুষের সাথে মানুষের এমন সম্পর্ক হতে পারে এটাই প্রথম।
প্রতিবেশী রফিকুল বলেন, আমরা খুবই অবাক হয়েছি। এমন ঘটনা আসলেই বিরল। এর আগে কখনও দেখিইনি আবার শুনিওনি। কবুতর মিজানুরের কথা শোনে। ঢাকলে কাছে চলে আসে। কবুতর রাজাবাবু কখনও তার পিঠে, কখনও মাথায় বা কথনও মোটর সাইকেলে ঘাড়ে বসে থাকে। এমন সম্পর্ক বিস্ময়কর। মানুষের সাথে পাখির এমন বোঝাপড়া সত্যিই ব্যতিক্রম। মিজানুরকে দেখতে না এসে, রাজাবাবুকে একনজর দেখার জন্য লোকজন ভীড় করছে মিজুনুরে বাড়ীতে।
মিজানুরের ভাইয়ের মেয়ে সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তানিয়া সুলতানা বলেন, আমি যখন বাড়িতে থাকি তখন রাজাবাবু সবসময় আমার কাছেই থাকে। ওকে কলে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। আমাদের বাড়িতে আরও অনেক কবুতর আছে কিন্তু সেগুলো আমার কাছে আসেও না আবার ডাকলেও শুনেনা। রাজাবাবু আমার কাছে যখন থাকে তখন আমার খুব ভালো লাগে।
মিজানুর রহমান বলেন, কারাজীবনে যখন দীর্ঘসময় যশোর কারাগারে ছিলাম তখন ভীষণ একাকীত্ব জীবণ কাটাতাম। তখন কারাগারের কবুতরগুলোর সাথে সময় কাটাতে শুরু করি। নিজে কম খেয়ে কবুতর গুলোকে খাওয়াছি। কারাগারেই নতুন করে একটি দেশি কবুতরের একজোড়া ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। তাদের নাম রাখি রাজা আর যাদব। সেই ছোট থেকেই আমি ওদের খাওয়াতাম। কবুতরগুলোও সারাক্ষণ আমার আশপাশে ঘুরে বেড়াত। একপর্যায়ে কবুতর দুটি কাঁধে উঠতে শুরু করে। আমি যেখানে ঘুমাতাম সেই বালিসের কোলে গিয়ে ওরা ঘুমাত। নামাজ পড়তে গেলেও আমার সাথে নামাজের পাটিতে বসে থাকত। এভাবেই ওদের সাথে আমার এক ভালোবাসা তৈরী হয়ে যায।
তিনি বলেন, কারাগারের সব কবুতরের প্রতি মায়া থাকলেও, রাজা আর যাদব নামের কবুতরের প্রতি আলাদা মায়া ছিল আমার। ২ জুন মুক্তির দিন ধার্য হয়। তার আগে থেকেই ওই দুই কবুতরের জন্য চিন্তা শুরু হয়। জেলে দুই কবুতরকে কার কাছে রেখে যাব ভাবছিলাম। তখন কোনো উপায় না পেয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলি। অবশেষে ২ জুন সন্ধ্যা ছয়টায় যখন কারাগার থেকে বের হলাম, তখন রাজা আর যাদবও আমার সঙ্গে চলে এল।
আরো বলেন, রাজার একটি সঙ্গী ছিল তার নাম রাণী। যাদব মারা যাবার কয়েক দিন পর রাণীও আবার যশোর কারাগারে ফিরে যায়। তখন কারাগার থেকে ফোনে আমাকে জানায় রাণী ওখানে চলে গেছে। সবথেকে বড় কথা হলো পূর্বে কারাগারে আমার যে কষ্ট হয়েছিল। সেই সব কষ্ট পরিবার ও রাজাবাবুকে পেয়ে ভুলে গেছি। এখন আমি আল্লাহ রহমতে অনেক শুখেই আছি।