ধর্ম ও জীবন

ইসলামের প্রথম যুগের মুয়াজ্জিন ছিলেন যারা

ঝিনাইদহের চোখঃ

মুয়াজ্জিনের মর্যাদা অনেক বেশি। ইসলামের প্রথম যুগে কাবা শরিফ কিংবা মদিনার মুয়াজ্জিন ছিলেন কারা? তাদের মুয়াজ্জিন হওয়ার পেছনের কারণই বা কি? কে তাদেরকে মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন? আসুন জেনে নিই কেনইবা ইসলামের ইতিহাসে এদের নাম লেখা রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে।

‘মুয়াজ্জিনুর রাসুল’ বা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিয়োগ দেয়া মুয়াজ্জিন ছিলেন ৪ জন। তাঁদের হৃদয়ে যেমন ছিল ইসলামের প্রতি ভালোবাসা তেমনি ছিল প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মহব্বত। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাঁদের অনেক ভালোবাসতেন। তারা হলেন-

কাবার মুয়াজ্জিন : আবু মাহজুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু
অল্প বয়সী গোফ না ওঠা সুমধুর কণ্ঠের অধিকারী ছোট্ট বালক আবু মাহজুরা। পবিত্র নগরী মক্কার অধিবাসী। মক্কা বিজয়ের পরে মক্কার কোনো এক উপত্যকায় হজরত বেলালের আজানের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। যে সূর প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হৃদয়কে আকৃষ্ট করে তোলে। যদি আবু মাহজুরার সে আজানের পুনরাবৃত্তি ছিল ঠাট্টামূলক।

আজান শেষে প্রিয়নবি উপত্যকায় অবস্থানরত বালকদের ডেকে পাঠালো। আজানের পুনরাবৃত্তিকার কে জানতে চাইলেন। যেহেতু আবু মাহজুরা ঠাট্টাচ্ছলে আজানের পুনরাবৃত্তি করেছিল, সে জন্য কেউ কথা না বলে চুপ থাকলো।

প্রিয়নবি একে একে সবার আজান শুনলেন। সবার শেষে আজান শুনলেন ছোট্ট বালক আবু মাহজুরার। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি আজান দিয়েছ? সে বলল ‘হ্যাঁ’। তখনও তাঁর গোফ ওঠেনি।

প্রিয়নবি আবু মাহজুরার মাথার পাগড়ি খুলে তার মাথায় হাত রেখে এ দোয়া করলেন-
‘আল্লাহুম্মা বারিক ফিহি, ওয়াহদিহি ইলাল ইসলাম।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি তাকে (আবু মাহজুরা) বরকত দাও এবং তাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফিক দাও।’

প্রিয়নবির হাতের স্পর্শে আবু মাহজুরার ভাগ্য খুলে গেল। সে তখনি বলে ওঠলো-
‘আশহাদু আললা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আন্নাকা রাসুলুল্লাহ।’ অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ব্যতিত সত্য মাবুদ নেই, আর নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসুল।

বিশ্বনবিও তখন আবু মাহজুরাকে মক্কাবাসীর জন্য বায়তুল্লাহর মুয়াজ্জিন নির্ধারণ করলেন। তখন প্রায় ৩০০ বছর ধরে আবু মাহজুরার বংশধর পবিত্র কাবা শরিফের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেন।

মসজিদে নববির মুয়াজ্জিন : বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু
ইসলামের চরম অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু। এমন কোনো বর্বর নির্যাতন ছিল না যা তার মনিব উমাইয়া ইবনে খালফ তাকে দেয়নি। শত নির্যাতনেও তাকে ইসলাম থেকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি।

হজরত বেলালকে চরম নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছেন হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। হজরত বেলাল স্বাধীন। মদিনায় হিজরত করলেন।

হিজরতের পর মসজিদে নববি নির্মাণ হলে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মসজিদে নববির মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দেন। আজানের প্রচলন হওয়ার পর থেকে নিয়মিত হজরত বেলালের সুললিত কণ্ঠে প্রচারিত হতো মসজিদে নববির আজান।

মসজিদে নববির মুয়াজ্জিন : আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহু
হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন মসজিদে নববির প্রথম ও প্রধান মুয়াজ্জিন। তিনি ছাড়াও আরো একজন মুয়াজ্জিন ছিলেন। তার নাম হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি ছিলেন অন্ধ সাহাবি।

বাহ্যিকভাবে অন্ধ হলেও তাঁর অন্তর ছিলো ইসলামের আলোয় আলোকিত। চরম অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম ছিলেন মদিনায় হিজরতকারী প্রথম দু’জনের একজন। মদিনায় মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা কুরআনের বাণী শুনাতেন।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত বেলাল ও আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে মদিনার মুয়াজ্জিন নিয়োগ দেন। তারা উভয়ে মসজিদে নববিতে আজান দিতেন। একজন আজান দিলে অন্য জন ইকামত দিতেন।

রমজান মাসে হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু সাহরির আজান দিতেন আর হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম ফজরের আজান দিতেন। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো কাজে মদিনার বাইরে যেতেন, তখন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম তার প্রতিনিধি করে যেতেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুপস্থিতিতে শত শত সাহাবি তার পেছনেই নামাজ পড়তেন।

মসজিদে নববি থেকে তার বাড়ি দূরে হওয়ার পর দৃষ্টিহীন সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম নিয়মিত জামাআতে নামাজ আদায় করতেন। কখনো জামাআত ত্যাগ করতেন না।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি পবিত্র কুরআনের হাফেজ ছিলেন।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সময়ে কাদেসিয়ার যুদ্ধে তিনি ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখতে গিয়ে কাফেরদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন। যখন তার হাতে পতাকা দেয়া হয়, তখনই তিনি বলেছেন, এ পতাকা সমুন্নত রাখব, না হয় শাহাদতের অমীয় সুধা পান করব।

মসজিদে কুবার মুয়াজ্জিন : সাদ আল কুরজি রাদিয়াল্লাহু আনহু
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্ব প্রথম মদিনায় হিজরত করে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সেটি হলো মসজিদে কুবা। এ মসজিদে কুবার প্রথম মুয়াজ্জিন ছিলেন হজরত সাদ আল কুরজি রাদিয়াল্লাহু আনহু।

হাদিসে এসেছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি মদিনা থেকে ওজু করে মসজিদে কুবায় গিয়ে ২ রাকাআত নামাজ আদায় করে তবে এক ওমরার সাওয়াব পাবেন।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুবায় প্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করেন। অতঃপর মসজিদে নববি নির্মাণ করেন। প্রিয়নবি মাঝে মাঝে মসজিদে কুবায় গিয়ে নামাজ আদায় করতেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ৪ জন ব্যক্তিকে ইসলামের মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দেন, এদের মধ্যে হজরত সাদ আল কুরজি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মসজিদে কুবার মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

এ কারণেই এ ৪জনকে ইসলামের ইতিহাসে ‘মুয়াজ্জিনুর রাসুল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button