হাজারো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মসিউর রহমানের দাফন সম্পন্ন
আব্দুল্লাহ আল মামুন, ষ্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহ চোখ-
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও ঝিনাইদহ-দুই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মসিউর রহমানের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। বুধবার (২ নভেম্বর) ঝিনাইদহ সরকারি বালক বিদ্যালয় মাঠে সকাল ১১ টায় বিএনপির এই প্রবীণ নেতার জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থাণীয় নেতৃবৃন্দসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ও হাজারও ভক্তবৃন্দ অংশ নেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধার জানাজা নামাজের আগে সরদ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমিন আক্তার সুমী’র নেতৃত্বে জেলা পুলিশের একটি টিম গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
এসময় জানাজা নামাজে উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো: শাহাজাহান, নিতাই রায় চৌধরী, বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মেহেদী হাসান রুমি, বিএনপির যুগ্ন-মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগাঠনিক সম্পাদক অনিন্দ ইসলাম অমিত, বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, তথ্য ও গবেশণা বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারি হেলাল, ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট এম এ মজিদ, সাধারণ সম্পাদক মো: জাহিদুজ্জামান মনা, সাংগাঠনিক সম্পাদক সাজেদুর রহমান পপ্পু, পাশ^বর্তী জেলার বিএনপির নেতাকর্মীসহ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন বিএনপির নেতাকর্মী ও হাজার হাজার ভক্তবৃন্দ জানাজা নামাজে উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই, হরিণাকুন্ডু উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর হোসেন, সদর পৌরসভার মেয়র কাইয়ুম শাহারিয়ার জাহেদী হিজলসহ অসংখ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা জানাজা নামাজে শরিক হন।
মরহুমের ঝিনাইদহে প্রথম জানাজা শেষে হরিণাকুন্ডু উপজেলার কন্যাদহ গ্রামে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বাবা মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার জেলা শহরের নিজ বাসায় সকাল ১১ টার দিকে ঘরের দরজা ভেঙ্গে তার অচেতন দেহ উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নেওয়ার পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ ছোঁয়া ইসরাইল তাকে মৃত বলে ঘোষনা করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। দুপুরের দিকে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িতে আনার সময় শত শত নেতা কর্মি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের থেকে জানা যায়, মসিউর রহমান বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারি ছিলেন। ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের কন্যাদহ গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন তিনি। স্কুল জীবনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের বিহার রাজ্যের চাকুলিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ঝিনাইদহ মহাকুমা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রথম (১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত) কমান্ডার হন তিনি।
৭৫ পরবর্তী বিএনপি গঠন হলে তিনি যোগদান করেন। এর আগে ১৯৭৭ সালে প্রথম হরিণাকুন্ডুর চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে কারাগারে থেকে নির্বাচনে অংশ নেন এবং তৃতীয় বার নিজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেন। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় ৭ মাস কারাভোগ করেন। এর আগে ১৯৭৯ সালে বিএনপি’র টিকিটে ঝিনাইদহ-২ আসনে জাতীয় সংসদ সদস্য পদে লড়াই করে তৎকালীন আইডিএল এর প্রার্থী মৌলানা ছামদানীর কাছে পরাজিত হন। কট্টর জামায়াত বিরোধী এই নেতা ১৯৯১ সালে প্রথম দলীয় (বিএনপি) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চার বার সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি।
বিরোধী দলীয় হুইপ, স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মসিউর রহমান বর্তমান ঝিনাইদহ, হরিণাকুন্ডু, শৈলকুপা, কুষ্টিয়া ও আলমডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। অনরবর্ষি বক্তা ও সংসদ সদস্য হিসেবে সারা দেশে পরিচিত ছিলেন তিনি। জাতীয়তাবাদি দল (বিএনপি) কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বড় ধরণের ভুমিকা পালনও করেছেন এই নেতা।
গত কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয়তায় বড় ধরণের ধাক্কা লাগে। নিজ দলের নানা মুখি সমালোচনায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। আপন চাচাতো ভাই আব্দুল মজিদের হাতে জেলা বিএনপির নেতৃত্ব চলে যায়। জেলা বিএনপির গুরুত্বপুর্ণ নেতৃবৃন্দ কাছ থেকে দুরে চলে যান। অভিমানে দলীয় কর্মকান্ড থেকে সরে যেতে থাকেন তিনি।
দলীয় সুত্র গুলো থেকে জানা গেছে ইদানিং হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। ঝিনাইদহে বেশী অবস্থান করতেন।
২০০৮ সালের ১৪ই ডিসেম্বর দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় ২০১৭ সালের অক্টোবরে যশোরের বিশেষ জজ আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদন্ড, জরিমানাসহ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রায় প্রদান করেন। কিছু দিন কারাভোগের পর উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি । সেই থেকে কমতে থাকে দাপট। কিন্ত তার মৃত্যু হাজারো মানুষের চোখের জল ঝরিয়েছে। গ্রাম গঞ্জের মানুষের কাছে জনপ্রিয় একজন মানুষ ছিলেন তিনি।
ঝিনাইদহ জেলা শহরে নাসিং ইন্সটিটিউট, সরকারী শিশু হাসপাতাল, ম্যাটস, হেলথ টেকনোলজি, খাবার স্যালাইন ফ্যাক্টরী, কৃষি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, ভেটেরিনারি কলেজ সহ অসংখ্য কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসা স্থাপন করে নজির স্থাপন করেন তিনি।