এই হলো আমরা , ঝিনাইদহবাসী—-শামীমা রহমান শিমু
এই হলো আমরা , ঝিনাইদহবাসী—-শামীমা রহমান শিমু
“এই দ্যাখেন খালা, আপনার ছাওয়াল রে একটু সামলাবেনেন , ওর দিক খিয়াল রাকপেনেন কয় দিন”—খালার ( আমার ছেলের সাথে ঢাকা থাকেন ) কথাগুলো শুনে রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম , ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে মুখ টা শুকিয়ে গেলো । আমার ছেলের বাবা আমার সামনেই বসা ছিলেন । তার কানে ও গেলো কথাগুলো ,দুজন দুজনের দিকে শংকিত চেহারায় তাকালাম ।
তারপর শীতল কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম —“কেনো খালা ? পৃথিবী ( আমার ছেলে ) কি খারাপ মানে কোন অন্যায় করেছে আপনার সাথে ?” খালা প্রশ্ন টা শুনে মুচকি হেসে বললেন —“দ্যাক দিন যাইত গেলো , আপনার ছাওয়ালের মতন ছাওয়াল আর হয় ?” খালার চোখ ছল-ছল করে উঠলো কারন খালার একটাই ছেলে , ছেলের সাথে সম্পর্কের অবনতির জন্য আমার কাছে খুলনা চলে এসেছিলেন ।
খালা আবার শুরু করলেন —“এরাম কতা কবেন না , আমি বেজার হয়ে যাবানে , বিশ্বাস করেন এই ঘরের তলে দাড়ায় কচ্ছি , আপনার ছাওয়ালরে আমি খুব ভালো পাই ।” আমি তো অস্হির হয়ে যাচ্ছি যে আমার ছেলে কি করলো ? খালার আসল কথা রেখে এসব কোন কথা কানে ঢুকছে না আমার । আমি —“তাহলে কেন বললেন এ কথা ?” খালা — “ও খালা আমাগের ইস্মারট কাড দেবে ঐ তা আনতি যাতি হবে দেশে ,সুমোয় লাগবেন না কয় দিন , মনির সেই কয় ডা দিন আপনি রান্না করে দেবেনেন , আমি ফাস করে যায়েয় মনির কাছে ঐ কোল ( ঝিনাইদাহ ) দিয়ে ঢাকা চলে যাবানে , এ কূলি ( খুলনা ) আর আসপোনানে।”
আমার ভাষা হারিয়ে ফেললাম খালার সব কথা শোনার পর , বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম কিছু সময়ের জন্য । আমার বর আমার দিকে তাকিয়ে বললো — “মনির দেশের লোক , তোমাদের কিছু না বলি, কথা শুনলে ভাষা খুঁজে পাই না।” মুখ বাঁকা করে হাসি দিয়ে উঠে গেলেন । ঘরে যারা কাজ করছিলো তাদের অট্ট হাসি তে ঘর কাঁপতে লাগলো । বাকী সবাই খুলনার । ওরা আমাকে প্রশ্ন করলো —“মামি ঝিনেদার মানুষ এরকম করে কথা বলে ?” আমি উত্তর না দিয়ে চুপ চাপ অসহায়ের মতন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম ।
আমার দাদা বাড়ী কন্যাদাহ । বাড়ি গেলে দাদা বাড়ি যেতেই হবে আমার ।ছেলে মেয়ে দুটো ও কন্যাদাহ কে নিজেদের গ্রামের বাড়ি বলে কারন ওদের দাদার আদি বাড়ি খুলনা শহরেই। সুতরাং আমাদের গ্রাম ছাড়া আর কোন গ্রাম নেই ওদের । ওদের কে কেউ জিজ্ঞাসা করলে গ্রাম কোথায় বলে কন্যাদাহ । আমি ও খুশিতে আপ্লুত হয়ে পরি , তখন আমার ও ভালো লাগে ।ওরা আমার সাথে মাঝে মধ্যেই যায় কন্যাদাহ ।দাদা বাড়ি গেলে আশে-পাশের সবাই ছুটে আসেন । চাচীরা ,বু-রা , মনি-রা, ভাইরা , চাচারা ,সবার আন্তরিকতা দিয়ে আমাদের পরিপূর্ণ করে তোলেন ।গরম গরম হুড়ুম থেকে শুরু করে পিঠা , গাছের শাক – সবজী , ফল- মুল , গরুর দুধ , পালা কুকড়ো -কুকড়ো ডিম , সেলাই করা কাঁথা এক কথায় যার ঘরে যা থাকে সবাই নিয়ে এসে দেন আমাদের জন্য ।
আলহামদুলিল্লাহ্, সবাই অনেক ভালবাসেন যত্ন করেন আমাদের ।আমাদের ঘিরে শুরু হয় কত গল্প , স্মৃতিচারণ , এক কথায় চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয় । সাথে চলে খানা পিনা । ছিটা রুটি , অনেক তেল ঝাল দিয়ে কুকড়ো রান্না , গরম গরম কাঁচ খোলা পিঠা ( চিতাই পিঠা ) সাথে কঁচুশাক ঘন্ট আর খেজুরের ঝোল গুড় — এ খাবার গুলো থাকবেই প্রতিবার ।আমাদের ভীষন পছন্দের খাবার এগুলো ।ছেলে মেয়ে ও আন্তরিকতার সাথে সব উপভোগ করে ।
তবে সব কিছুর সাথে যে ঘটনার সম্মুখীন বেশির ভাগ সময়ে হয় সেটা হলো —“এ শিমু, এ মনি এই দ্যাকেক তোর মনি কয়ডা ?সে দিনির মনি আমাগের একুন নিজিই মনির মা । সুমোয় দেকতি দেকতি যায় ।” পাশ থেকে আরেক জন কথা টেনে শুরু করে — “তা না তো কি , সেদিন কের কতা না … শিমু বাবু আইসতো , সারা পাড়া ঘুরে বেড়াতো, গাছে চইড়তো , পুকুরি লাবলি আর উটতি চাতো না , ডুবোয় ডুবোয় পানি খায়ে কাঁদা মাকে ঘাট ঘুলা করে দিতো ,উগার দুই ভাই বুনির টানে উটানো যাতো না , ধানের ভুঁই তি ধান তুলতি যাতে আমাগের ছাওয়াল মেয়ের সাতে , ছুলা পুড়ায় হুড়ো করতো , চাল ডিম আলু তুলে সব চড়ুই ভাতি করতো , বিচেলির পালার উপর উটে লাফ দিতো পাল্লা দিয়ে “….. এ রকম বিভিন্ন ইতিহাস শুরু হয়ে যেতো ।
আমার ছেলে মেয়ে ও মন দিয়ে শুনে, যে ভাষা না বুঝে আমার কাছে জেনে নেয় আর মুখ টিপে হাসে আমার দিকে তাকিয়ে ।তারা তাদের হার্ড ডিস্কে সব সেভ করে নিয়ে আসে ।
ঝিনাইদাহ ফেরার পথে শুরু হয়ে যায় তাদের দম বন্ধ করা হাসি আর গবেষণা। একটাই প্রশ্ন — “মা , মনির আবার মনি হয় কি করে ?” এটা কেমন প্রশ্ন ! ওরা হাসে আর আমাকে বলে —“ও শিমু মনি ৫.৮” ইঞ্চি হাতেড় ছাওয়ালের মা তুমি , আর কত দিন মনি সাজে থাকবা ? বুড়ী হবে না ?” আমি ও হাসি , এক অজানা ভাললাগা অনুভব করি ।খুলনাতে আমাকে এরা “মনির” দেশের লোক বলে । সেদিন গোরকি ভাই , অন্জু মামা , মতিন ভাই খুলনা এসেছিলেন , আমি আর মেয়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম , ফেরার পথে মেয়ে বললো —“মা উনারা তো তোমাকে বা আমাকে কেউ মনি বললো না ! উনাদের বাড়ি কি নানা বাড়ির থেকে দূরে ?” এদের এসব প্রশ্ন আমাকে মজা ও আনন্দ দেয় । আমার বাবা তার বড় ছেলের বউ কে মনি বলেই ডাকেন। আমার মুখে মনির গল্প শুনে আমাকে ও ঝিনেদার বাইরের মানুষ মনি বলে ডাকেন ।আত্মতৃপ্তি , পরিপূর্ণতা ,ভালবাসাতে গর্বে আমার বুক ভরে যায়, কোন কোন সময় আবেগী হয়ে পরি , চোখ ছল-ছল করে উঠে । আসলেই ঝিনেদার মানুষের আন্তরিকতা কমতি নেই ।অতিথি পরায়ণ, সদাজ্জ্বল আলাপী এবং আন্তরিক ।শিক্ষা ও অর্থের দিক থেকে গরীব হলেও মনের দিক থেকে আমরা ঝিনেদা জেলাবাসী ধর্নাঢ্য বড়লোক । এই হলো আমরা — ঝিনাইদহবাসী