কালীগঞ্জ

ফনির প্রভাব পড়েছে ঝিনাইদহের মানুষ বেচাকেনার হাটে

হাবিব ওসমান, ঝিনাইদহের চোখঃ

সকাল থেকেই রাস্তার পাশে বসে অপেক্ষা। আশা কেউ তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। মিলবে কাজের নিশ্চয়তা। কিন্ত কৃষকেরা এখন চলমান ঘুর্ণিঝড় ফনির পূর্বাভাসে বোরো ধান কাটতে চাচ্ছেন না। ফলে আপাতত শ্রমিক নিতে আগ্রহ নেই গ্রামের কৃষক অথবা গৃহস্থদের।

দুর-দুরান্তের জেলা থেকে কাজের সন্ধ্যানে এসে শ্রমিক হাটে ওঠা শ্রমিকেরা কাজ না পেয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। রাস্তার দু”ধারে বসে থাকা শ্রমিকদের পাশ ঘেষে কেউ দাঁড়ালেই কাজের আগ্রহে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকছেন। এমন দৃশ্য ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ শহরের শ্রমিক বেচাকেনার হাটের।

জানাগেছে,এ এলাকায় প্রতিবছর প্রচুর পরিমানে বোরো ধানের চাষ হয়। মাঠের সমস্ত ধানই প্রায় একই সাথে কাটা উপযোগী হয়ে ওঠে। আবার ঝড়োবৃষ্টি এ সময়টাতে প্রায়ই হানা দেয়। ফলে সকলেই চায় ক্ষেতের ধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই আগে ঘরে তুলতে। যে কারনে বেড়ে যায় কৃষি শ্রমিকের কদর। তাদের কেউ কেউ সুযোগ বুঝে মজুরিও হাকিয়ে নিতে চায় খেয়াল খুশি মত। এমন চাহিদার সময়ে দুর-দুরান্তের জেলা থেকে শ্রমিকেরা এসে কালীগঞ্জ শহরের শ্রমিকের হাট নামক বিশেষ স্থানে জড়ো হন।

কৃষক বা গৃহস্থরা নিজের প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে বাড়িতে নিয়ে যান। শ্রমিকদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থাও থাকে ওই কৃষকের বাড়িতে। অনেকে ব্যঙ্গ করে এটাকে মানুষ বেচাকেনার হাট বললেও প্রকৃত পক্ষে কৃষক ও শ্রমিক এতে উভয়ই উপকৃত হয়ে থাকেন। শ্রমিকরা বলছেন,তারা নিজেরা বিক্রি হন না বিক্রি করেন শ্রমকে।

এ ব্যাপারে বাজারে শ্রমিক নিতে আসা উপজেলার তালিয়ান গ্রামের কৃষক লুৎফর রহমান বলেন, বাইরের জেলার শ্রমিক না আসলে শ্রমিক সঙ্কটে পড়ে অতিরিক্ত টাকা দিলেও শ্রমিক মেলানো যেতো না। এতে বৃষ্টি বাদলে মাঠের ধান পঁচে গলে নষ্ট হয়ে যেতো। আবার এ হাটে আসলে বেকার শ্রমিকেরাও কাজ পেয়ে পয়সা রোজগার করতে পারছে। ফলে পদ্ধতিটা উভয়রই জন্য মঙ্গল। তিনি বলেন, আবহাওয়া খারাপ তারপরও পাবনা থেকে আসা ৬ জন শ্রমিককে প্রতিদিনের হাজিরা চুক্তিতে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।

সকালে কালীগঞ্জ শহরের কাঁচাবাজার সড়কে গেলে দেখা যায়, রাস্তার দু’ধারে কাস্তে ,মাথাল (বাঁশের পাতলা চটা দিয়ে বোনা রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাথায় দেওয়া বিশেষ টোপর) ছাড়াও কৃষি কাজের বিভিন্ন উপকরণসহ কাপড়ের পোটলা নিয়ে বসে আছেন শত শত মানুষ। তারা অধির আগ্রহে আছেন কখন গৃহস্থ এসে চুক্তির মাধ্যমে তাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। সকালের দিকে শ্রমিকেরা আশায় বুক বেধে থাকলেও দুপুরের পরে বৃষ্টি শুরু হলে তাদের কাজ পাওয়ার স্বপ্ন ম্লান হয়ে যায়। কিছু শ্রমিক চুক্তি মোতাবেক কাজ পেলেও বিকাল পর্যন্তও শ্রমিক হাটে অধির আগ্রহে বসে থাকতে দেখা গেছে অনেককে।

এ সব শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, পাবনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে কাজের সন্ধ্যানে এখানে এসেছেন। এ এলাকায় বোরো মৌসুমে কাজ করে পরিবার পরিজনের জন্য কিছু পয়সা নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।

তারা জানান, কাজের সন্ধ্যানে এসে এখন পড়েছেন চরম বিপাকে। চলমান বৈরি আবহাওয়া ও ঘুর্নিঝড় ফনির পূর্বভাসের কারনে কৃষকেরা আপাতত মাঠের ধান কাটতে চাচ্ছেন না। ফলে কাজ মিলছে না। এদিকে খালি হাতে বাড়িও ফিরতে পারছেন না তারা।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার নিমাইচরা গ্রাম থেকে কালীগঞ্জ শহরের শ্রমিক হাটে আসা কৃষি শ্রমিক মকবুল হোসেন জানান, তাদের এলাকাতেও বোরো ধানের চাষ হয়েছে। কিন্ত কাটার উপযোগী হতে এখনও কমপক্ষে ২০ দিন সময় লাগবে। ততদিন এলাকায় তেমন একটা কাজ নেই। তাই তাদের গ্রাম থেকে ২৮ জনের একটি দল ৩ দিন আগে এ এলাকায় এসেছেন কাজের জন্য। দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পূর্বাভাসের কারনে কৃষকেরা এখন ধান কাটতে রাজি নই। ফলে কাজ মিলছে না।

এখন পয়সা খরচ করে এসে কাজ না করেই হয়তো বাড়ি ফিরে যেতে হবে।
একই উপজেলার পানাকোড়া গ্রামের শাহিন, আলাউদ্দীন, আব্দুল করিম জানান, ২ দিন আগে এ এলাকায় এসে কাজ পাইনি। কাছে যে পয়সা ছিল তাও প্রায় শেষের দিকে এখন কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।

কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার গবরা গ্রাম থেকে আসা শ্রমিক হাবিবুর শেখ, রইচ উদ্দীন , আপান শেখ, সবুজ হোসেন জানান, তারা গরীব মানুষ। সারাবছর কৃষি শ্রমিকের কাজ করেই সংসার চালাতে হয়। তাদের এলাকার কৃষকেরা বোরো চাষ না করে পেঁয়াজের চাষ করেন। যে কাজ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন এলাকায় আর কাজ নেই। এদিকে বাড়ি বসে থাকলেও না খেয়ে থাকতে হবে। তাই কাজের সন্ধ্যানে এ এলাকায় এসে বিক্রি হওয়ার জন্য হাটে উঠেছিলাম। কিন্ত কোন গৃহস্থ নিতে চায়নি।

তারা জানান,এ এলাকার মাঠের অর্ধেক ধানও কৃষকেরা ঘরে তুলতে পারেননি। কিন্ত দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কেটে না গেলে ধান কাটা কাজ পুনরায় শুরু হচ্ছে না। ফলে শ্রমিক কাজে লাগছে না তাদের। তাছাড়াও আবহাওয়া কয়দিন এমন থাকবে তাও বোঝার উপায় নেই। ফলে খালি হাতে বাড়ি ফেরা ছাড়া উপায় নেই।

কালীগঞ্জ উপজেলার খেদাপাড়া গ্রামের কৃষক সাধন কুমার ঘোষ জানান, এ বছর ৬ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করে এ পর্যন্ত মাত্র ২ বিঘা জমির ধান মাঠ থেকে বাড়ি এনেছেন। প্রতিবছর বোরোধান ঘরে তোলার সময়ে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়।

তখন এ এলাকার কৃষকেরা কালীগঞ্জ শহরের শ্রমিক থেকে বাইরের জেলার শ্রমিকদের কিনে যান। বিনিময়ে তাদেরকে খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করা লাগে। একবারে কাজ শেষ করে তারপরও শ্রমিকেরা ওই বাড়ি ত্যাগ করে আবার অন্য কৃষকের কাজ ধরেন। কিন্তু বর্তমান দূর্যোগপূর্ন আবহাওয়ায় কখন জানি কি হয় ভেবে কৃষকেরা ধান কাটা আপাতত বন্ধ রেখেছেন। যে কারনে দুর্যোগ না কাটা পর্যন্ত শ্রমিক আর লাগছে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button