অন্যান্য

লড়াকু এক নারীর নাম রূপন্তী

#ঝিনাইদহের চোখঃ

‘জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা, জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টিকা।’ এই পঙক্তিমালার মাধ্যমে নারী বহ্নি শিখারূপে জেগে উঠে তার অধিকার আদায় করে নেবে এমন সমাজের স্বপ্নই দেখেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

আজ নারী কেবল গৃহবাসিনী নয়। কৃষি শ্রমিক থেকে শুরু করে বিমান চালনা, দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবখানে এখন নারীর জয়-জয়গান। আবহমান বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য লাঠিখেলাতেও পিছিয়ে নেই নারীরা।

এমনই একজন লড়াকু নারীর নাম মঞ্জুরীন সাবরীন চৌধুরী রূপন্তী। কুষ্টিয়ার মেয়ে রূপন্তী যখন খোলা চুল আর কালো পোশাকে এক হাতে লাঠি অন্য হাতে ঢাল, আবার কখনও লাঠির বদলে তলোয়ার নিয়ে ছুটে যান প্রতিপক্ষের দিকে তখন হাততালি পড়ে চারদিক থেকে। রূপন্তীর ডাগর চোখে তখন তেজিভাব।

রূপন্তীর লাঠিখেলার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে ২০১৬ সালে। ওই বছরের জানুয়ারি মাসে দেশের লাঠিয়ালদের একমাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী’ দুইদিনের উৎসবের আয়োজন করে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ মাঠে। কুষ্টিয়া ছাড়া নড়াইল, ঝিনাইদহ, পাবনা, নাটোর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ২৫টি দলের প্রায় ৫০০ লাঠিয়াল অংশ নেন এ উৎসবে।

এসব দলে পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি নারীরাও ছিলেন। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের মাঠে লাঠিখেলায় অন্যদের মতো সাবরীন চৌধুরী রূপন্তীও লাঠিখেলা দেখান। ওই সময় তার লাঠিখেলায় মুগ্ধ হন সবাই। খেলায় সুন্দর মুখশ্রীর সঙ্গে বড় লাল টিপ, খোলা চুল আর কালো পোশাকের সমাহার নিয়ে তিনি যেন নারী শক্তির প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হন। যখন তিনি লাঠি হাতে তীরের বেগে তেড়ে যান প্রতিপক্ষ লাঠিয়ালের দিকে তখন তার চোখে যেন আগুন ঝরে। তাকে ঠেকাতে হিমশিম খেয়ে যায় প্রতিপক্ষ। এরপর তার লাঠিখেলার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

বলা যায় লাঠিখেলা রূপন্তীর রক্তে মিশে আছে। কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন লাঠিখেলার সংগঠক ও এই এলাকার শ্রেষ্ঠ লাঠিয়াল। লাঠিখেলাকে বাঁচিয়ে রাখতে ও সারাদেশের লাঠিয়ালদের সংগঠিত করতে ১৯৩৩ সালে একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এ সংগঠনের নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পরিবার আজও লাঠিয়াল পরিবার হিসেবে পরিচিত। শহরের পূর্ব মজমপুরের যে সড়কের সামনে এই লাঠিয়াল সংগঠকের বাড়ি ওই সড়কের নাম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নামে নামকরণ করা হয়েছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী হলেন মঞ্জুরীন সাবরীন চৌধুরী রূপন্তীর দাদা। বাবা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুর পর সংগঠনের হাল ধরেন রতন চৌধুরী, যিনি রূপন্তীর বাবা। লাঠিখেলা তাই রূপন্তীর পারিবারিক ঐতিহ্য। তার বয়স যখন সাত বছর তখন বাবার খেলা দেখে হাতে তুলে নেন লাঠি। লাঠি ঘোরানো রপ্ত করতে থাকেন রূপন্তী। শিখে নেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার কৌশল। রূপন্তীর ওস্তাদ ছিলেন ওসমান সরদার।

এ বিষয়ে রূপন্তী বলেন, মূলত ওসমান সরদারের কাছ থেকেই আমার লাঠিখেলার হাতেখড়ি। তিনি আমার দাদার মতোই। তিনি আমার দাদার হাতে তৈরি, দাদার কাছে লাঠিখেলা শিখেছেন তিনি। যেহেতু দাদা বেঁচে ছিলেন না, আমার ওস্তাদ ওসমান সরদার চেয়েছিলেন দাদার কাছ থেকে শেখা কৌশল আমাকে কিছুটা হলেও শিক্ষা দেবেন।

বর্তমানে রূপন্তীর পরিবারের সবাই লাঠিখেলার সঙ্গে যুক্ত। আছেন নারীরাও। রূপন্তীর ফুফু হাসনা বানু দেশের প্রথম নারী লাঠিয়াল। ফুফাতো বোন শাহিনা সুলতানা ও শারমীন সুলতানাও লাঠিয়াল। রূপন্তীর সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট বোন মঞ্জুরীন আফরিনও লাঠির কসরত শিখছেন।

রূপন্তী বলেন, আমার বাবার কোনো ছেলে সন্তান ছিল না। বাবা চেয়েছিলেন তার মেয়েরাই ছেলেদের কাজ করবে। নিজেই নিজের আত্মরক্ষা করবে। তাই নিজেকে কখনও অন্যের থেকে আলাদা ভাবিনি। সেই থেকে আর পিছু হটা হয়নি। লাঠি, সড়কি, তলোয়ার ও রামদা চালাতে পারি আমি। অবশ্য আমার মা লাঠিয়াল নয়। তবে তিনি সবসময় আমাদের লাঠিখেলায় উৎসাহ দেন। ছোটবেলায় আমাকে বাবার সঙ্গে পাঠিয়ে দিতেন।

বাবার সঙ্গে নড়াইলের সুলতান মেলায় তিনবার লাঠিখেলায় অংশ নিয়েছিলেন রূপন্তী। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসিতে পহেলা বৈশাখে লাঠিখেলা দেখিয়েছেন। এছাড়া কুষ্টিয়ায় লাঠিখেলার আয়োজন কখনও মিস করেন না তিনি। এসএসসি পরীক্ষার আগে রূপন্তীর বাবা রতন চৌধুরী মারা যান। এসএসসি পাসের পর চাচাতো ভাই সাব্বির হাসান চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় রূপন্তীর। তবে পড়ালেখার পাশাপাশি এখনও লাঠিখেলা অব্যাহত রেখেছেন রূপন্তী। বর্তমানে তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের ছাত্রী। মিরপুরে স্বামীর সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকেন। তার স্বামী সাব্বির হাসান চৌধুরীও লাঠি খেলেন। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।

রূপন্তীর ভাষ্য, লাঠি শুধু খেলায় না আত্মরক্ষাও বটে। কোনো বিপদে হাতের কাছে লাঠি জাতীয় কিছু থাকলে সেটা দিয়ে নারীরা নিজেদের রক্ষা অনায়াসে করতে পারেন। এটা শিখতে তেমন সময় বা টাকা খরচ হয় না। এটা রপ্ত করা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে এটা ছড়িয়ে দেয়া খুবই প্রয়োজন।

রূপন্তী বলেন, আমার দাদা লাঠিখেলা নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তার জন্যই বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে উঠেছে। তিনি অনেক বই লিখেছেন। চেষ্টা করেছেন মার্শাল আর্টের সঙ্গে লাঠিখেলা কম্বাইন্ড করে যেটা তৈরি করা যায় সেটি করতে। এর মধ্য দিয়ে লাঠিখেলা চলে আসছে। তবে মার্শাল আর্ট কিছুটা বাদ পড়ে গেছে। আবার নতুন করে মার্শাল আর্ট ও লাঠিখেলা কম্বাইন্ড করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমি।

তিনি বলেন, দাদার স্বপ্ন ছিল লাঠিখেলাটা একদিন বিশ্বে পরিচিতি অর্জন করবে দেশীয় ঐতিহ্য হিসেবে। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি আমি।

প্রথম নারী লাঠিয়াল হাসনা বানুর ছেলে ও বাংলাদেশ লাঠিয়াল বাহিনীর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আধুনিক খেলাধুলার ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসা ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলাকে বাঁচিয়ে রাখতে সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। রূপন্তীর মতো দেশের অন্য নারীদের আত্মরক্ষার্থে এই লাঠিখেলার প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button