মানুষের আচরণের উপর রংয়ের প্রভাব
#ঝিনাইদহের চোখঃ
প্রায় সকলের কিছু পছন্দের রং থাকে। কিন্তু এ রং আমাদের আচরণের উপর কতটা প্রভাব রাখে সেটা দেখার বিষয়।
আমাদের মনে কি কখনও প্রশ্ন জেগেছে ফাস্ট ফুডের দোকানগুলোর বেশিরভাগেরই লোগো কেন লাল বা কমলা রঙের হয়? কেন সুবিশাল নীল আকাশের দিকে তাকালেই মনটা শান্ত, স্থির হয়ে যায়? কেন আমরা ব্যস্ত শহুরে জীবনের ঝুট ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে ছুটে যাই সবুজ প্রকৃতির কোলে? হয়তো না। আসলে চারিদিকে হরেক রকমের রং দেখে আমরা এতটাই অভ্যস্ত যে, আমাদের কার্যকলাপ ও আচরণের উপর একেক রংয়ের যে একেক ধরনের প্রভাব আছে, তা আর সচেতনভাবে লক্ষ্য করা হয়ে ওঠে না।
অথচ প্রতিনিয়তই আমরা আমাদের পরিচ্ছদ ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের রঙের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি। তাই একেকটি রং আমাদের শরীর ও মনের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে, তা জানাতেই আজকের এই আয়োজন। এর পাশাপাশি এসব প্রভাব বিবেচনায় রেখে কীভাবে পোশাকের রং এবং ঘরের রং নির্বাচন করা যায়, তাও তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
একাধিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে৷ দেখা যাচ্ছে,মানুষের মস্তিষ্ক দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে৷
রংয়ের কী প্রভাব থাকতে পারে? আমাদের উপর রংয়ের প্রভাব সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার কোনো অভাব নেই৷ যেমন বলা হয়ে থাকে, লাল রং নাকি সক্রিয় করে তোলে৷ নীল রং আস্থা জাগায়৷ আর সবুজ রং নাকি আমাদের আরাম দেয়৷ বিজ্ঞানের মানদণ্ড ব্যবহার করে কি রংয়ের প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া সম্ভব? কিন্তু রং আসলে কী?
মানুষের চোখ লাখ লাখ রং আলাদা করতে পারে৷ আসলে রং কিন্তু আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে৷ কারণ বিজ্ঞান বলছে, একমাত্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য হিসেবে রংয়ের অস্তিত্ব রয়েছে৷ রং আসলে আলোর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণের সামান্য অংশমাত্র৷ অনেকটা এক্সরে, অতি বেগুনি রশ্মি বা বেতার তরঙ্গের মতো৷
খালি চোখে দেখা যায়, এমন আলোর মাত্রা সাধারণত ৪০০ থেকে ৭৮০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত হয়৷ সেই বিকিরণ রংয়ের রূপে দেখা যায়৷ এই সব তরঙ্গদৈর্ঘ্য একসঙ্গে সাদা রং সৃষ্টি করে৷ নির্দিষ্ট কোনো রং বার করতে কী করতে হয়?
রং আমাদের শরীরে কি কোনো প্রভাব ফেলে? ব্যাপারটা এভাবে ঘটে৷ সাদা আলো কোনো বস্তুর উপর পড়ে৷ বস্তু তার কিছু অংশ গিলে ফেলে৷ বাকি অংশের প্রতিফলন ঘটে৷ তাই সব তরঙ্গদৈর্ঘ্য আমাদের চোখ পর্যন্ত পৌঁছায় না৷ মস্তিষ্ক সেই আলোর সঙ্কেতের ব্যাখ্যা দেয়৷ ফলে আমরা চিনতে পারি যে টমেটোর রং লাল! অর্থাৎ রং সবার আগে আমাদের মনে জন্ম নেয়৷ কিন্তু সে কারণেই কি রং আমাদের উপর প্রভাব রাখতে পারে?
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল অনুযায়ী সেই প্রভাবে হেরফের হয়৷ কারণ রংয়ের প্রভাব শিক্ষাদীক্ষার উপরেও কিছুটা নির্ভর করে৷ শুধু লাল ও সবুজ রংয়ের ক্ষেত্রে মানুষ সম্ভবত বিবর্তনের সময় থেকে একই মনোভাব দেখিয়ে আসছে৷ মনস্তাত্ত্বিক হিসেবে হাইকো হেশ্ট এক পরীক্ষার মাধ্যমে এই সত্য জানার চেষ্টা করেছেন৷
তিনি বলেন, আমরা সব সময়ে একই ওয়াইন পান করেছি৷ একবার একদল মানুষ লাল আলোর নীচে তা পান করেছে৷ দ্বিতীয় দল সবুজ আলোর নীচে সেটা করেছে৷ দেখা গেছে, তাঁদের উপর রং বিশাল প্রভাব ফেলেছে৷
যারা সবুজ আলোর নীচে সেই ওয়াইন পান করেছেন, তাঁদের স্বাদ টক লেগেছে৷ একেবারেই পছন্দ হয় নি৷ যে দল লাল আলোর নীচে সেই ওয়াইন পান করেছে, তাদের স্বাদ খুব ভালো লেগেছে৷ এমনকি ওয়াইনের বোতলের জন্য এক ইউরো বেশি দিতেও তারা প্রস্তুত ছিল৷
খাবারের মধ্যে লাল রং পরিপূর্ণতার প্রতীক এবং আমাদের স্বাদেরও উন্নতি ঘটায়৷ তবে লাল আলোও যে একই প্রভাব রাখতে পারে, এমনটা আগে জানা ছিল না৷
লাল
লাল রং সাধারণত প্রণয়, ভালোবাসা, স্নেহময়তা, শক্তি, উত্তেজনা, সতেজতা এবং তীব্র আবেগ নির্দেশ করে।
নীল
নীল রং প্রশান্তি, শীতলতা, বিশ্বস্ততা, প্রজ্ঞা, সততা, আবেগশূন্যতা, বিরাগ, কেন্দ্রীভূত আচরণ প্রভৃতিকে নির্দেশ করে।
হলুদ
এটি খুশি, আনন্দ, উচ্ছ্বলতা, স্নেহময়তা, আশাবাদীতা, তীব্র আবেগ, ক্ষুধা, হতাশা এবং রাগ প্রকাশ করে।
গোলাপী
এই রংটি মূলত প্রণয়, ভালবাসা, নম্রতা, প্রশান্তি, নির্দোষিতা, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতার সাথে জড়িত। কমলা এটি আনন্দ, উত্তেজনা, উদ্দীপনা, উদ্ভাবনক্ষমতা, সক্রিয়তা, সহিষ্ণুতা, স্নেহময়তা, সম্পদ, উন্নতি ও পরিবর্তনের পরিচয় বহন করে।
সবুজ
এই রং প্রকৃতি, শান্তি, শীতলতা, উন্নতি, স্বাস্থ্য, উর্বরতা, অর্থ, অসুস্থতা ও ঈর্ষার প্রতীক।
কালো
এ রং কর্তৃত্ব, ক্ষমতা, শক্তি, বুদ্ধি, নিরাপত্তা এবং কোনো কোনো সংস্কৃতিতে অমঙ্গল, দুর্দশা, মৃত্যু বা শোকের চিহ্ন বহন করে। লাল রং কি আমাদের কর্মক্ষমতার উপরেও প্রভাব রাখে? অন্য একটি পরীক্ষার মাধ্যমে হাইকো হেশ্ট তা জানতে চেয়েছিলেন৷ এই পরীক্ষার আওতায় স্বেচ্ছাসেবীদের বিভিন্ন রংয়ের পরিবেশে বসানো হয়েছিল এবং তাদের কাছে হুবহু এক অঙ্ক, ভাষা ও ধাঁধার প্রশ্ন রাখা হয়েছিল৷ সবাই একই রকম ভালো ফল করেছে৷ এ ক্ষেত্রে লাল রংয়ের সম্ভবত কোনো প্রভাব ছিল না
লাল রং কি আমাদের কর্মক্ষমতার উপরেও প্রভাব রাখে? অন্য একটি পরীক্ষার মাধ্যমে হাইকো হেশ্ট তা জানতে চেয়েছিলেন৷ এই পরীক্ষার আওতায় স্বেচ্ছাসেবীদের বিভিন্ন রংয়ের পরিবেশে বসানো হয়েছিল এবং তাঁদের কাছে হুবহু এক অঙ্ক, ভাষা ও ধাঁধার প্রশ্ন রাখা হয়েছিল৷ সবাই একই রকম ভালো ফল করেছে৷ এ ক্ষেত্রে লাল রংয়ের সম্ভবত কোনো প্রভাব ছিল না৷
কিন্তু ওয়াইন নিয়ে পরীক্ষার সময় কেন পার্থক্য দেখা গিয়েছিল? মনস্তত্ত্ববিদ হিসেবে হাইকো হেশ্ট বলেন, আংশিকভাবে আবেগের মাধ্যমে সেই প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল বলে মনে হয়৷ অপেক্ষাকৃত কম সময়ের জন্য আবেগ কাজ করে৷ অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদী প্রভাব দেখা গিয়েছিল৷ আচমকা সব লাল হয়ে যাওয়ায় আবেগেও পরিবর্তন ঘটেছিল, যা সরাসরি ওয়াইনের স্বাদে পার্থক্য এনেছিল৷ কোনো ছাত্রীকে এক ঘণ্টার জন্য পরীক্ষায় বসালে এবং পরে লাল আলোর নীচে একই কাজ করতে দিলে আমাদের উপলব্ধিবোধ যথেষ্ট দ্রুত পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়৷ লাল রংয়ের অস্তিত্ব খেয়ালও করে না৷