কালীগঞ্জের ১২টি গ্রামে পুষ্টিগুন পরামর্শ দিয়ে চলেছেন ২৮ পুষ্টিযোদ্ধা
শাহজাহান আলী বিপাশ, ঝিনাইদহের চোখ-
সোমা দেবনাথ একজন গৃহবধু। বাড়ির অন্য কাজের পাশাপশি তিনি নিজে বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ, হাস মুরগি পালনসহ নানা কাজ করেন। একই সাথে এলাকার হতদরিদ্র নারীদের পুষ্টি,স্বাস্থ্য রক্ষা, পুষ্টিগুণ বজায় রেখে রান্নার কৌশল জানাসহ নিজের বাড়ির পরিত্যক্ত আঙিনা ব্যবহার করে কিভাবে নিরাপদ উপায়ে সবজি উৎপাদন করা যায় সে বিষয়ে সহায়তা প্রদান করছেন। সোমা দেবনাথের মতো পুর্ব বলামপুর গ্রামের স্মৃতি দেবনাথও একজন গৃহবধু। বাড়ির কাজের পাশাপাশি পাশ্ববর্তী ভোলপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র লক্ষিত নারীদের তিনিও একই ধরনের সেবা দিচ্ছেন। আগমুন্দিয়া গ্রামের ফারহানা সাকিনসহ ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ১২টি গ্রামে এবং রায়গ্রাম ইউনিয়নের একটি গ্রামে ২৮জন এলএসপি (লোকাল সার্ভিস প্রোভাইডার) প্রায় ৩৮৮জন হতদরিদ্র লক্ষিত নারীদের মাঝে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে গত দুই বছর ধরে।
এই এলএসপিগণ যে নিজেরা স্বচ্ছল এমনটা নয়। নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও এলএসপিগণ গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছেন। পুষ্টি-স্বাস্থ্য-নিরাপদ খাদ্য, পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নিজেরা জীবনাচরণে পরিবর্তনে এগিয়ে চলেছেন। নিজেদের বাড়ির কাজের পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নে এবং নারীদের স্বাস্থ্য,পুষ্টি বিভিন্ন বিভিন্ন বিষয়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে তাদের অর্জিত জ্ঞান লক্ষিত নারীদের সাথে শেয়ার করছেন এবং উন্নয়নের পরামর্শ দিচ্ছেন। ২৮জন এলএসপি এলাকার ১৩টি গ্রামের ৪০০ জন লক্ষিত নারীকে সহায়তা করছেন। এলএসপিদের এই কার্যক্রমে বেড়েছে নারীদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনা,খাদ্যের পুষ্টি রক্ষা, নিজের বাড়ির আঙিনায় নিরাপদ উপায়ে সবজি এবং ওষুধী গাছ লাগানোর কার্যক্রম। এলএসপিদের এই কার্যক্রম ইতিমধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। আর এই ২৮জন এলএসপিকে সার্বিক সহযোগিতা করছেন জাপান ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড। হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড এর ডেভলপমেন্ট প্রকল্পের এর চলমান প্রজেক্ট এর সহযোগী হিসেবে নিজেরা আলোকিত হয়ে অন্যের মাঝে আলো ছড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে এলএসপিগণ ব্রত নিয়েছেন পরিবর্তনের।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার আড়–য়াশলুয়া গ্রামের শিখা খাতুন। পড়াশোনা করেন। পাশাপাশি লোকাল সার্ভিস প্রোপাডার হিসেবে কাজ করনে। মাসে ২দিন তিনি গ্রামের হতদরিদ্র লক্ষিত নারীদের নিয়ে উঠান বৈঠক করেন। তিনি জানান, সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আলোচনা হয় খাদ্যের পুষ্টি রক্ষা করা, নারীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক, সমবায় গঠন,সঞ্চয় করা, বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষসহ বিভিন্ন বিষয়ে। এরকমভাবে জেসমিন আক্তারও তার জীবনে পরিবর্তন আনয়নের পাশাপাশি লক্ষিত নারীদের সহায়তা প্রদান করে আসছেন।
হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের প্রোগ্রাম অফিসার এস এম শাহীন হোসেন জানান, লোকাল সার্ভিস প্রোভাইডাররা মূলত নিজের গ্রামের হতদরিদ্র লক্ষিত নারীদের নিয়ে কাজ করে। অধিকাংশ এলএসপি তাদের বাড়িটাকে মডেল তৈরি করেছে। এরপর অন্য নারীদের সেই ভাল কাজগুলো করার জন্য উঠান বৈঠকের মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান করছেন। তিনি জানান, নিয়ামতপুর ইউনিয়নের নিয়ামতপুর গ্রামের জেসমিন আক্তার ১৫জন, রোজিনা বেগম ১৪ জন,মুন্নি খাতুন ১৩জন, মহিষাডেরা গ্রামের নাহিদা আক্তার ১০জন, অনুমপুর গ্রামের অঞ্জনা রানী ১৬জন, শাহনাজ পারভীণ ১৪জন, হরিগবিন্দপুর গ্রামের রতœ খাতুন ১৫জন, মোজাহিদ ইসলাম ১৫জন, ভোলপাড়া গ্রামের স্মৃতি দেবনাথ ১৪জন, মাধুরী বিশ্বাস ১৫জন, বলরামপুর গ্রামের সোমা দেবনাথ ১৫জন, ফরিদা বেগম ১২জন, মরিয়ম খাতুন ১৩জন, সাথী ঘোষ ১২জন, মল্লিকপুর গ্রামের আফরোজা বেগম ১৮ জন, আম্বিয়া খাতুন ১৫জন, নাসরিন আক্তার ১৬জন, আড়–য়াশলুয়া গ্রামের শিখা খাতুন ১৪জন, সাথী খাতুন ১৩জন, বলাকান্দর গ্রামের মর্জিনা আক্তার ১৭জন, মহেশ্বরচাদা গ্রামের লিপিকা ঘোষ ১৪জন, কবিতা খাতুন ১২জন, দাপনা গ্রামের রেবেকা খাতুন ১৫জন, মোস্তবাপুর গ্রামের রোজিনা আক্তার ১৪জন, খাদিজা খাতুন ১৪জন এবং রায়গ্রাম ইউনিয়নের আগমুন্দিয়া গ্রামের ফারহানা সাকিন ১০জন, বিউটি আক্তার ১৩জন ও তাজরিন ফারহানা ১০ জন লক্ষিত বা হতদরিদ্র নারীদের এই কাজে সম্পৃক্ত করেছেন।
এলএসপিদের এই কাজ বিষয়ে সংস্থার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর সোহেল রানার মতে, সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের পুষ্টি উন্নয়নে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড এর পরিচালনায় চলমান প্রজেক্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং উক্ত প্রজেক্টকে সফল করতে একজন পুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে এলএসপিগণ এর ভূমিকা এবং অবদান অনস্বিকার্য। আমরা বিশ্বাস করি, এলএসপিগণ তাঁদের আন্তরিকতা ও অর্জিত জ্ঞান দিয়ে উত্তরত্তর নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রচেষ্টা অব্যহত রাখবে। সংস্থার কার্যক্রম কোনকারণে গ্রামগুলো থেকে নিষ্ক্রিয় হলেও উক্ত গ্রামে বা এই মানুষগুলোর কাছে অর্জিত জ্ঞান যুগ যুগ থেকে যাবে যা পরম্পরায় চলামান থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকুক, মানুষ তার বুদ্ধি, জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাক এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।