ঝিনাইদহের ঐতিহ্য খেজুর গাছ ও রস
হারিয়ে যাচ্ছে ঝিনাইদহের ঐতিহ্য খেজুর গাছ। এক সময় খেজুরের রস ও গুড় প্রসিদ্ধ ছিল। মার্কেটে এর চাহিদা ছিল প্রচুর। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর, কোটচাাঁদপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষ শীতকালীন সময়ে অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল ছিল খেজুর গাছের উপর। সেই হিসেবে খেজুর গাছ অর্থকারী ফসলের মধ্যে পড়ে ।
জানা যায়, এখন থেকে প্রায় ৯০০বছর পূর্বে এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে খেজুর গাছ ছিল । কৃষকরা খেজুর বাগান তৈরী করতো বানিজ্যিকভাবে। প্রাকৃতিক ভাবেও এটা জন্মাতো। এই খেজুর গাছ কে ঘিরে তৈরী হতো মহল। যারা গাছ কাটে তাদেরকে বলা হতো গাছী এবং রস জালানোর আকাকে বলা হতো বান, হাড়ীকে বলা হতো জালা, টিনের গুলিকে বলা হতো তাপাল । বৃটিশ আমলে এ জেলায় খেজুরের চিনি উৎপাদনের জন্য প্রচুর কারখানা গড়ে ওঠে বৃহত্তম যশোরের ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ,মহেশপুর ও যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায় প্রচুর পরিমান খেজুরের গুড় ও চিনি উৎপাদনের কথা শোনা যেত।
কপোতাক্ষ নদের কোল ঘেষে চিনি উৎপাদনের কারখানা গড়ে উঠেছিল। এর কারণ হিসাবে জানা গেছে খেজুরের চিনি তৈরী করতে পাট্টা শেয়ালার প্রয়োজন হতো বৃটিশ অমলে বঙ্গদেশে খেজুরের গুড় থেকে চিনি তৈরীর প্রধান কারখানা ছিল কোটছাঁদপুরে। সে সময় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন গরুর গাড়ীতে করে গুড় বিক্রির জন্য কোটচাঁদপুরে আসতো। কপোতাক্ষ ও ভৈরব নদী দিয়ে লঞ্চ ও বড় বড় নৌকা দিয়ে বরিশাল ও নোয়াখালী জেলায় ব্যাবসায়ীরা খেজুরের গুড় নিয়ে যেত এবং সেখান থেকে অন্য মালামাল বৃহত্তর যশোর জেলায় বিক্রির জন্য নিয়ে আসা হতো ।
আরও জানা যায়, উনবিংশ শতাদ্বীর প্রথম ভাগে ইউরোপ হতে চিনি কারবার করতে এ দেশে আসে মি. ব্লেক (ইষধশব) সাহেব পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার (ভারত) বাগদা নামক স্থানে প্রথমে খেজুরের গুড় থেকে চিনি প্রস্তুত কারখানা হয়। কিন্তু সেখানে প্রচুর লোকসান হতে থাকে । কোটচাঁদপুর এই চিনির ব্যবসার সুনাম থাকায় চিনি কোম্পানী পর্যায়ক্রমে চৌগাছায় চিনির কারখানা চালু করেন কলকাতার গ্লায়্টোন উইল এন্ড কোং এবং এর ম্যানেজার ছিলেন ম্যাকলিয়ড সাহেব। ১৮৬১ সালের দিকে এই অঞ্চলে অনেক কারখানা গড়ে উঠে।
ইউরোপীয়দের মতে চিনি ছাড়াও মদ তৈরী করা হতো। কারখানা ক্রমেই লোকসানের পরিমান বেশী হওয়ায় ১৮৮০ সালে মিঃ নিউ হাউস বিক্রি করে দেন এমেট চেম্বার্স কোম্পানির নিকট।
১৮৭৪ সালের একটি হিসাব মতে, কোটচাঁদপুর ৬৩টি চিনি কারখানা চালু ছিল। ১৯০৯ সালের পর চিনি শিল্প বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে যায় । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত দুই বাংলায় গুড়ের ব্যবসা ছিল জমজমাট । মহেশপুর অঞ্চলের লোকজন পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার মাজদে বাজারে গুড় বিক্রি করে সাপ্তাহিক বাজার করে নিয়ে আসতো। দেশ স্বাধীনের পর এ অঞ্চলের অধিকাংশ খেজুরের গুড় রপ্তানি করা হতো সিলেট অঞ্চলে।
বর্তমানে খেজুর গাছ নিধন এবং বানিজ্যকভাবে চাষ না হওয়ায় খেজুর গাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। খেজুর গুড়ের চিনি শিল্পের এখনো নির্দশন বহন করছে কোটচাঁদপুর শহরের মাছের বাজারে। এই স্থানটি ছিল চিনি শিল্পের প্রধান কারখানা। এই অর্থকারী ফসলটি এখনও বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব যদি সরকারের কৃষি মন্ত্রনালয় উদ্যোগ গ্রহন করে।