কালীগঞ্জটপ লিড

কালীগঞ্জে মানবতার চাদরে মহত্বের ছড়াছড়ি

সাবজাল হোসেন, ষ্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহের চোখ-

ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের ময়ধরপুর গ্রামের রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অজ্ঞাত অসুস্থ এক মানসিক প্রতিবন্ধি। ময়লা মাখা শরীর কিন্ত মানুষ তো। সে সময়ে দেখতে ভীড় করেছেন গ্রামের লোকজনসহ উৎসুক পথচারীরা। সন্ধ্যা গড়িয়ে ঘনিয়েছে রাত। সে সময়ে যারা সামনে গেছেন শুধু মুখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকাচ্ছিলেন এই প্রতিবন্ধী। ফলে বোঝা যাচ্ছিল তখনও বেঁচে আছেন। শুধু দরকার জরুরী চিকিৎসাসেবা।

কিন্ত কে দায়িত্ব নিয়ে ঝামেলা পোহাবেন। এমন ভেবে সময় যত গড়িয়েছে কমেছে উৎসুক জনতার ভীড়। তাই বলে একজন মানুষ চোখের সামনে চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে। এটাও হতে পারে না।

এমন ভাবনা থেকেই দিনমজুর আমজাদ সমাজসেবক আব্দুর রশিদসহ গ্রামের বেশ কয়েকজন এগিয়ে এসেছেন। তারা গাঁটের টাকায় গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসেন কালীগঞ্জ হাসপাতালে। কর্তব্যরত চিকিৎসকের মুখে কথা শুনে তো তারা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কেননা তিনি বললেন মেয়েটি অন্তঃসত্ত¡া। এখন তার খাবার আর বিশ্রাম দরকার।

এদিকে একটু সুস্থ হতেই হাসপাতালের বেডে শুয়ে প্রতিবন্ধি শুরু করেন পাগলামী। বাধ্য হয়ে তাকে নিয়ে তারা আবার ফেরেন এলাকায়। এরপরের চিত্র আরও ভিন্ন। এমন অবস্থায় কে দাঁড়াবেন তার পাশে?

উৎসুক জনতার কাতার থেকে অনেকে বলেছেন এই প্রতিবন্ধি কোলাবাজারে প্রায় দুই মাস ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যরা যাই ভাবুকনা কেন এই অসহায় মানসিক প্রতিবন্ধির পাশে দাঁড়িয়েছেন দিনমজুর আমজাদ। তিনি প্রতিবন্ধিকে সাথে নিয়েই বাড়ি ফিরেছেন। সংসারে অভাব আছে তারপরও আমজাদের স্ত্রী ছাকিরন বেগমও স্বামীর কর্মকান্ডকে স্বাগত জানিয়েছেন। অনেক সময় নিজেদের চুলা জ্বলে না।

কিন্ত প্রতিবন্ধিকে নিজের সংসারের সদস্য মনে করে তিনিও মানবিক হয়েছেন। মহত্বের পরিচয় দিয়ে বাড়িতে রেখে প্রতিবন্ধির শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চিকিৎসা ও যাবতীয় সেবাযতœ দিয়েছেন। আমজাদ-ছাকিরনের দম্পতির এমন মহত্বের কথা তুলে ধরে ২ অক্টোবর ঐতিহ্যবাহী জাতীয় দৈনিক সংবাদ ”দিনমজুর আমজাদের মানবিকতার দৃষ্টান্ত” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয়। ওইদিন বিকালেই কালীগঞ্জ হাসপাতালে প্রতিবন্ধি ফুটফুটে চেহারার কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অজোপাড়াগায়ের এমন ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী মা ও সন্তানের দায়িত্বভার গ্রহনের মহৎ ঘোষনায় সর্বমহলে প্রশংসায় ভেসেছেন। নবজাতকটির জন্মের পরেই স্থানীয় সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনার ছুটে গিয়ে মা ও নবজাতকের চিকিৎসার যাবতীয় খোঁজখবর নিয়ে মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন। পরে রাতে হাসপাতালে ছুটে আসেন ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সূবর্ণা রানী সাহা ও স্থানীয় গনমাধ্যমকর্মিরা। এ সময় জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ নবজাতকটিকে আদরে কোলে নিয়ে নাম দেন আদরী।

তিনি আশ্রয়দাতা আমজাদ- ছাকিরন দম্পতির হাতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা তুলে দিয়ে মহত্বের পরিচয় দেন। বিষয়টি নিয়ে গত ৩ অক্টোবর দৈনিক সংবাদ ও খুলনাঞ্চাল ও অনলাইন পোর্টাল সবুজদেশ নিউজ, ঝিনাইদহের চোখ, খবর কালীগঞ্জ, বেগবতি, বর্ণময় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আবার ”সেই মানসিক প্রতিবন্ধী নারীর পাশে সরকার” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

মা ও মেয়ে আদরীর চিকিৎসাসহ যাবতীয় ব্যয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দেয়া হবে জেলা প্রশাসকের এমন উদারতাপূর্ণ ঘোষনা দেশব্যাপি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।

পরে ৫ অক্টোবর সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আব্দুল লতিফ শেখ, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা কৌশিক আহম্মেদ আদরীকে কোলে তুলে নেন। সাথে সাথে আমজাদ- ছাকিরন দম্পতির হাতে ১০ হাজার টাকার চেক প্রদান করে মহত্বের পরিচয় দেন।

ফুটফুটে চেহারার আদরীকে অনেকে নিতে চেয়েছেন। কিন্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শিশু কল্যান বোর্ড সভায় আমজাদ – ছাকিরন দম্পতির হাতেই তুলে দেয়ার মহৎ সিদ্ধান্ত হয়। যা ৫ গত অক্টোবর দৈনিক সংবাদের প্রথম পাতায় ”কালীগঞ্জের সেই প্রতিবন্ধী ও কন্যা আদরীর ঠিকানা আমজাদের বাড়ি শিরোনামে পুনরায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর ৬ অক্টোবর ফেসবুক ভিত্তিক কালীগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষা গ্রæপ ওই পরিবারের হাতে ১৪ হাজার ৫শ টাকা তুলে দিয়ে মহত্বের পরিচয় দেন।

অন্যদিকে এমন অসহায় প্রতিবন্ধীকে নিয়ে ধারাবাহিক মানবিক প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দৈনিক সংবাদের কপি সংশ্লিষ্ঠ পোষ্ট দিয়েছেন জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সূবর্ণা রানী সাহা। সাথে সাথে মুঠোফোনে সংবাদ প্রতিবেদক ও সংবাদ পরিবারকে ধন্যবাদ দিয়ে মফস্মল পর্যায়ের সকল মিডিয়াকর্মিদের এমন মানবিক প্রতিবেদন লেখনির মাধ্যমে তুলে ধরার জন্য উৎসাহিত করে মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

অন্যদিকে গ্রামের একজন অসহায় মানসিক প্রতিবন্ধীর প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়ে যে মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন এবং স্থানীয় জেলা প্রশাসক যেভাবে সংবাদকে তুলে ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট দিয়েছেন সে জন্য সংবাদ পরিবার ও কালীগঞ্জের কর্মরত সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ও জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ,উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।

অসহায় প্রতিবন্ধির খবর প্রকাশের পর থেকে এ পর্যন্ত মা মেয়ের কল্যানে যা কিছু হয়েছে সবই যেন মানবতার চাদরে মহত্বের ছড়াছড়ি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button