জানা-অজানা

বাঙালি মুসলমানের নবাব সলিমুল্লাহ

ঝিনাইদহের চোখ-

বাঙালি জাতির ইতিহাসকে হাজার বছরের ধারাবাহিকতা থেকে দেখার সাধারণ মৌখিক প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের জন্ম কোনো আচমকা ঘটনা নয়, সে কথা আমরা স্বীকার করি। এদেশে মুসলমান সমাজের বিকাশ খুব পুরনো কোনো গল্প নয়। হাজার বছরের পেক্ষাপটে সাম্প্রতিকই বলা চলে। আমাদের সবারই জানা আছে, হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদের পদতলে বয়ে চলা ছোট জাতের ভারতীয় মানুষের দীর্ঘ দাসজীবন। মুসলমানরাও রেহাই পায়নি সে ঐতিহাসিক উঁচু নাকের অগ্নি-নিঃশ্বাস থেকে। ফলে- ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পূর্ব-বাংলার মুসলমান সমাজের মুক্তির জন্য বিশেষ রাজনৈতিক ভাবনা ছিল এক ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতা। দরিদ্র শোষিত বাঙালি মুসলিম জনজাতির মুক্তির স্বতন্ত্র সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মাইলস্টোনগুলো তাই এদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক চিহ্ন। এই চিহ্ন নির্মাণে নেতৃত্বের ভূমিকা যারা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে প্রধানতম পুরুষ নবাব স্যার সলিমুল্লাহ।

মুসলমান সমাজের ওপর বৈষম্য দূর করতেই তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে বঙ্গভঙ্গের দাবি পেশ করেছিলেন। ইতিহাসে এই ঘটনাকে যতই বিতর্কিতরূপে প্রচার করা হোক না কেন, বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা মুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হিসেবে সেটিকে অবশ্যই বিচার করতে হবে। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব কোনো সাম্প্রদায়িক প্রস্তাব ছিল না, বরং সাম্প্রদায়িক বঞ্চনা থেকে দরিদ্র মুসলমানের মুক্তিসাধনের উপায়

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ওরফে খাজা সলিমুল্লাহ কেবল বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণের অগ্রদূতই ছিলেন না, ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম সমাজের মহানায়ক। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এই মহান শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক ও রাজনীতিক নবাব পরিবারের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়েছিলেন। প্রথমত, ভারতবর্ষের বর্ণবাদি হিন্দু আধিপত্যবাদের কালে পূর্ব বাংলার বঞ্চিত মুসলমান জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তির মানসে। তৎকালীন ভারতের নবগঠিত ব্যবস্থাপক সভায় কোনো মুসলমান প্রতিনিধি না থাকায় অপরাপর মুসলমান নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ব্যবস্থাপক সভা ও বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে আলাদা নির্বাচনের দাবি তিনি তুলেছিলেন। ১৯০৬ সালে ঢাকায় তার উদ্যোগে আয়োজিত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজের শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গড়ে তোলার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। তার জীবনকালে ঢাকায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় দেখে যেতে না পারলেওÑ এর বীজ তিনিই রোপণ করে গিয়েছিলেন এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে এ অঞ্চলের কেবল শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের কেন্দ্রই নয়, হয়ে উঠেছিল বাঙালির ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সার্বিক মুক্তি সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল। তিনি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রধান উদ্যোক্তাই ছিলেন না, বাবার নামে ঢাকায় নিজের জমিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) রূপ নেয়। মুসলমান সমাজের ওপর বৈষম্য দূর করতেই তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে বঙ্গভঙ্গের দাবি পেশ করেছিলেন।

ইতিহাসে এই ঘটনাকে যতই বিতর্কিতরূপে প্রচার করা হোক না কেন, বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীর বঞ্চনা মুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হিসেবে সেটিকে অবশ্যই বিচার করতে হবে। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব কোনো সাম্প্রদায়িক প্রস্তাব ছিল না, বরং সাম্প্রদায়িক বঞ্চনা থেকে দরিদ্র মুসলমানের মুক্তিসাধনের উপায়। সলিমুল্লাহ ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনের অন্যতম আহ্বায়ক এবং তার প্রস্তাবে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে ভারতীয় মুসলিম নেতাদের এক সভায় মুসলিম লীগ গঠিত হয়। সলিমুল্লাহর জন্ম না হলে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজের দাস হয়ে থাকা বাংলার চাষাভুষা মুসলিম সমাজের জাগরণ অসম্ভব ছিল। অসহায় মানুষের কল্যাণে নিজের সব সম্পদ বিলিয়ে দিতে সামান্যও কার্পণ্য করেননি পূর্ব বাংলার মুসলিম জাগরণের এই সর্বভারতীয় নায়ক। সেকালের পত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ সলিমুল্লাহর বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অসংখ্য সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ এপ্রিল পত্রিকাটি তার সম্বন্ধে লিখেছিল, ‘মাননীয় নবাব বাহাদুর পূর্ববঙ্গের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।’ একদিকে তিনি ঢাকায় ঈদ, ফাতেহা-ই-দোয়াজদাহম প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কৃতি বিকাশে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, আরেকদিকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর খেলাধুলা, গান-বাজনা, ফটোগ্রাফ, বায়স্কোপ প্রদর্শনী, নাট্যাভিনয়, প্রভৃতি শিল্প-সংস্কৃতিমূলক কার্যক্রমে উদারভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছেন। ঢাকার নাগরিক সংস্কৃতি বিকাশের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

ধর্মপ্রাণ নবাব সলিমুল্লাহ বাল্যকালেই নবাবীর মোহ ত্যাগ করেছিলেন এবং ব্রতী হয়েছিলেন সর্বসাধারণের জীবনমান উন্নয়নের সাধনায়। তিনিই সর্বপ্রথম পানীয় জল, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে সূচনা করেছিলেন আধুনিক ঢাকা নগরীর। তারই উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম বিজলি বাতির আলো জ্বলেছিল আহসান মঞ্জিলে। তার উদারনৈতিক কার্যক্রম সাক্ষী দেয়, তিনি রাজনীতির চেয়েও শিক্ষাকে বঞ্চনা থেকে মুক্তির শক্তিশালী হাতিয়ার গণ্য করতেন। ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় এ জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন নৈশ বিদ্যালয়। তিনি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মানুষের উন্নয়ন ঘটাতে চাননি, পুরো সমাজে জারি রাখতে চেয়েছেন সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম চর্চার আধুনিক পরিবেশ ও ব্যবস্থা।

বাস্তবে নবাবী না করলেও তিনি ছিলেন মানুষের হৃদয়ের নবাব। মানবকল্যাণে কাজ করতে গিয়ে নবাব সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ সরকারের কাছে ঋণ নিয়েছিলেন নিজের সম্পদ বন্ধক রেখে। এ ঋণ তিনি শোধ করে যেতে পারেননি। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সে ঋণের সুরাহা করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়তো স্বাভাবিক ছিল; কিন্তু মুসলমানের আলাদা দেশ পাকিস্তানের সরকারও এর কোনো সুরাহা করেনি। তবে, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের অসাড়তা বুঝতে বাঙালির খুব বেশি দিন সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঠিকই জন্ম নিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ উদার মুসলমানের দেশ- অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই ৪৯ বছর পার করা স্বাধীন বাংলাদেশের উচিত নবাব স্যার সলিমুল্লাহকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঋণমুক্ত ঘোষণা করা। তদানীন্তন পূর্ব বাংলার অবহেলিত মানুষের জন্য নবাব সলিমুল্লাহর বৌদ্ধিক সংগ্রাম ও ত্যাগ আমাদের জাতিগত ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে নবাব সলিমুল্লাহর সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরম্পরাগত যোগসূত্র অত্যন্ত নিবিড়। মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ, এবং সেখান থেকেই জন্ম নেয় বাঙালির পরিপক্ব রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। সুতরাং, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাব ও তার দল আওয়ামী লীগের অতুলনীয় নেতৃত্বে যে বাংলাদেশের জন্ম, সেই বাংলাদেশের সামান্য হলেও দায় আছে নবাব স্যার সলিমুল্লাহকে যথাযথ সম্মান জানানোর। অথচ, কেবল তার স্মৃতি সংরক্ষণের কিছু বস্তুগত নমুনা ব্যতীত স্যার সলিমুল্লাহর জনসেবা ও ঢাকা নগরজীবন উন্নয়নে অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করা স্যার সলিমুল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর সম্মানজনক কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। নবাব সলিমুল্লাহকে বাদ দিয়ে বাংলার মানুষের হাজার বছরের বঞ্চনা থেকে মুক্তির ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হবে না। আজকের বাংলাদেশকে সত্যিকারের শিক্ষা ও জ্ঞানভিত্তিক আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহর কর্ম ও রাজনীতি পুনর্মূল্যায়ন করা আবশ্যক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button