কোটচাঁদপুরক্যাম্পাস

ঝিনাইদহের রাশেদুল কী মেডিকেল ভর্তির সুযোগ পাবে না? দুশ্চিন্তায় পরিবার

ঝিনাইদহের চোখ-

অর্থের অভাবে এক দিনও প্রাইভেট পড়া হয়নি রাশেদুল ইসলামের (২০)। উল্টো নিজের পড়ার খরচ জোগাতে ছয় মাস ছাত্র পড়িয়েছেন। নিজের চেষ্টায় সারা জীবন পড়ালেখা করেছেন পাড়াগাঁয়ের এই মেধাবী ছেলে। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অদম্য মেধার পরিচয় দিয়েছেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ হয়েছে তাঁর।

কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণে এখন বড় বাধা অর্থ। ভর্তি থেকে শুরু করে পরবর্তী পড়ালেখার খরচ কীভাবে জুটবে, এই চিন্তা এখন গোটা পরিবারের। বাবা মজনু মড়া কলের লাঙলের চালক। অন্যের গাড়িতে কাজ করেন। মাঠে মাঠে জমি চাষ করেন। এভাবে যা আয় করেন, তা দিয়ে ঠিকমতো সংসারই চলে না, সেখানে ছেলের পড়ার খরচ কোথা থেকে আসবে এই চিন্তা তাঁর। পরিবারের সদস্যদের আশঙ্কা, অর্থের অভাবে ছেলের স্বপ্ন শেষ না হয়ে যায়।

রাশেদুলদের বাড়ি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার ফাজিলপুর গ্রামে। সামিয়া মরিয়ম (৭) নামের তাঁর আরেকটি ছোট বোন রয়েছে। রাশেদুলের বাবা মজনু মড়া প্রথম আলোকে বলেন, অভাবের সংসার তাঁর। নিজের মাঠে কোনো চাষযোগ্য জমি নেই। মাত্র ৯ শতক জমির ওপর ভিটেবাড়ি। মাটির এক কক্ষের ঘরের মধ্যে রাশেদুল পড়ালেখা করেন। আর বারান্দা ঘিরে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী ছোট মেয়েকে নিয়ে ঘুমান। বাড়িতে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি আর কবুতর পালন করেন তাঁরা।

মা ফিরোজা বেগম বলেন, ছোটবেলা থেকেই রাশেদুলের পড়ালেখার প্রতি খুবই আগ্রহ। সারাক্ষণ পড়ালেখা নিয়েই থাকেন। কখনো ছেলেকে পড়ার কথা বলতে হয়নি। বাড়িতে পড়ালেখা করেই সব সময় ভালো ফল করেছেন। কোনো পরীক্ষায় রাশেদুল দ্বিতীয় হননি। মা বলেন, ‘ছেলের অনেক দিনের স্বপ্ন ডাক্তারি পড়ার। এখন মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু পড়ানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। স্বামী কলের লাঙল চালিয়ে দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করেন। বছরে ৪ মাস এই কাজ হয়। লাঙল নিয়ে দূরদূরান্তে চলে যান। বাকি ৮ মাস বাড়িতে গরু লালনপালনের পাশাপাশি কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এভাবে কোনো রকমে সংসার চলে। ছেলেকে পড়ালেখার খরচ ঠিকমতো দিতে পারি না। গ্রামের লোকজন ও স্কুলের শিক্ষকেরা মাঝেমধ্যে কিছু সহযোগিতা করেছেন, যা দিয়ে ছেলের পড়ালেখার কিছু খরচ হয়েছে। তা ছাড়া মোটা টাকা প্রয়োজনের সময় বাড়ির একটি গরু বিক্রি করতে হয়েছে।’

ফিরোজা বেগম বলেন, এখন ছেলের ভর্তিসহ পরবর্তী পড়ালেখার খরচ কীভাবে জোগাড় করবেন, তা নিয়ে চিন্তিত তাঁরা। কখনো কখনো মনে হচ্ছে টাকার অভাবে ছেলের স্বপ্ন শেষ না হয়ে যায়।

রাশেদুল বলেন, বাবা পড়ালেখার খরচ দিতে পারেন না, তাই কখনো প্রাইভেট পড়তে যাননি। বাড়িতে পড়ালেখা করেই ভালো ফল নিয়ে এসেছেন। ভালো ফলের ব্যাপারে তিনি বলেন, দিন-রাতে কমপক্ষে ১৪ ঘণ্টা পড়ালেখা করেছেন তিনি। বাড়ির বাইরে খুব কম যেতেন। তিনি বলেন, গ্রামের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলেন। এরপর পার্শ্ববর্তী রামনগর কে বি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ নিয়ে এসএসসি পাস করেন। একই গ্রামে অবস্থিত এ অ্যান্ড জে কলেজ থেকে ২০২০ সালে এইচএসসি পাস করছেন। করোনা পরিস্থিতিতে পরীক্ষা দিতে না পারলেও আগের ফলাফলের ভিত্তিতে ফলাফল জিপিএ-৫ এসেছে।

রাশেদুল আরও বলেন, এসএসসি পাসের পর অর্থের অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারছিলেন না। এমন সময় তাঁর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আসাদুজ্জামান লেন্টু টাকা দিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। এই সুযোগ না হলে তখনই হয়তো পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেত। রাশেদুল চিকিৎসক হয়ে গ্রামের মানুষের সেবা করার স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন পূরণে সবার সহযোগিতা চান তিনি।

রামনগর কে বি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আসাদুজ্জামান লেন্টু বলেন, ‘ছেলেটি খুবই গরিব ও অসহায়। তবে পড়ার প্রতি রয়েছে যথেষ্ট আগ্রহ। যে কারণে আমরা মাঝেমধ্যেই সহযোগিতা করে থাকি। মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েও আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল রাশেদুল। আমি তাকে সাহস দিয়েছি, কিন্তু প্রয়োজন অর্থের।’

গ্রামের বাসিন্দা শ্যামল কুমার বলেন, ‘রাশেদুলের মতো ছেলে পাওয়া যায় খুবই কম। সে ডাক্তার হলে এলাকার মানুষ উপকৃত হবে।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button