ঝিনাইদহের কৃতি সন্তান কারুশিল্পী জোয়ারদার মাহমুদকে বিদায়
টোকন ঠাকুর
সূত্র-প্রথম আলো
সমকালীন চিত্রশিল্পীদের অনেককেই আমরা চিনি, কেউ কেউ ততটা চেনা হয়ে ওঠেন না। যাঁদের চিনি, সেই চেনা–জানাতে গণমাধ্যম একটা বড় ভূমিকা পালন করে। কোনো কোনো শিল্পী গণমাধ্যম থেকে কিছুটা দূরেই থেকে যান। সে কারণেই, গণপরিচিতি তাঁদের কম থাকে। তাঁরা তাঁদের কাজেই বেশি মনোযোগী থাকেন। শিল্পী জোয়ারদার মাহমুদ সেই মনোযোগী শিল্পীদের একজন।
ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে ঝিনাইদহে গিয়েছিলেন। ঝিনাইদহেই তাঁর পৈতৃক বাড়ি। বাল্যকাল কেটেছে সেখানেই। চিত্রকলায় লেখাপড়ার জন্য পরে ভর্তি হন খুলনা আর্ট কলেজে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের অধীনে খুলনা আর্ট কলেজ থেকে প্রাক্-ব্যাচেলর অব ফাইন আর্ট কোর্স সম্পন্ন করে চলে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের কারুকলা বিভাগে। এখান থেকেই ব্যাচেলর অব ফাইন আর্টসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পেশাগত জীবনে তিনি সুনামের সঙ্গে ফ্রিল্যান্সার শিল্পী হিসেবে কাজ করেন।
গত ৯ মে ঝিনাইদহে তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। তাঁকে স্থানীয় সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যান শিল্পী জোয়ারদার মাহমুদ। পরদিন ১০ মে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পথে মানিকগঞ্জে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন এই শিল্পী। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৪ বছর। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং অগণন বন্ধুবান্ধব-স্বজন রেখে তিনি আকস্মিক চলে গেলেন।
স্বল্পভাষী কিন্তু সদা হাস্যোজ্জ্বল জোয়ারদার মাহমুদ স্বজন ও বন্ধুমহলে পল্টু নামেই ছিলেন বেশি পরিচিত। স্বজনেরা শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে ‘পল্টু’র জন্য। ফেসবুকের নিউজফিড ছবির পরে ছবি ও স্মৃতিকথার ঝাঁপি খুলে দিয়েছে। শিল্পীর স্বজনেরা এই মৃত্যু মেনে নিতে হতবাক হয়ে পড়েছেন।
কারুকলায় শিল্পী জোয়ারদার মাহমুদের চিন্তার অভিনবত্বই তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। মাস্ক বানানোর নতুন নতুন ফর্ম ও টেকনিকে তিনি রসিকদের নজর কেড়েছেন। এ কারণেই পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনে চারুকলায় যত কর্মকাণ্ড, জোয়ারদার মাহমুদ ছিলেন সেখানে নেতৃত্বের অন্যতম একজন শিল্পী। তিন দশক ধরে তিনি প্রধানদের একজন হয়ে বৈশাখী মেলার মুখোশ নির্মাণে যুক্ত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বা ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আলপনা ও সাজসজ্জা কার্যক্রমেও তিনি অন্যতম একজন হিসেবে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এই দুটি কাজই চারুকলার ছেলেমেয়েরা করে থাকেন ভালোবাসা থেকে, সৃষ্টির তাড়না থেকে। বাজার অর্থনীতির এই যুগে এসেও বিনা পয়সায় এ রকম দিনের পর দিন পরিশ্রম করে চলেন শিল্পীরা। কাজেই আগামী পয়লা বৈশাখ ও ২১ ফেব্রুয়ারিতে চারুকলার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলী তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করবেন। একদা তিনি থাকতেন স্যার এ এফ রহমান হলের বর্ধিত আবাসন শহীদ শাহনেওয়াজ ভবনের ২১ নম্বর রুমে। চারুকলা থেকে বেরিয়ে গেলেও প্রত্যহ সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে আসতেন, চারুকলার দেয়াল ঘেঁষে যেসব স্বপ্ননির্মাতা দাঁড়িয়ে বা বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেন, জোয়ারদার মাহমুদ পল্টুর অনুপস্থিতি থাকবে সেখানেও। তাঁর অনুপস্থিতি থাকবে ঝিনাইদহে, সেখানকার বন্ধু–স্বজন ও পরিবারে তিনি আর কখনোই হাসতে হাসতে আসবেন না।
প্রিয় পল্টু ভাই, অনেক স্মৃতি। শুধু মন খারাপ করে বসে আছি। খুব মন খারাপ আজ। খুলনা-ঝিনাইদহ বা ঢাকায় আপনাকে আর কোনো দিন দেখা পাব না! অসমাপ্ত থেকে গেল জীবনের অনেক কিছুই।
খুলনা আর্ট কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় তিনি আমার অগ্রজ হলেও দারুণ এক বন্ধুত্ব ছিল আমাদের সম্পর্কের মধ্যে। চারুকলাতেই তাঁর সঙ্গে আমার স্মৃতি অধিক। এবার ঈদে ঝিনাইদহ গিয়ে ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় পল্টু ভাইকে পেলাম অধুনালুপ্ত চান্দা সিনেমা হলের পাশে, শাহিনের ব্যবহারিক আর্টের দোকানে। শিল্পী মামুন হুসাইন, সংস্কৃতিকর্মী কাজল বিশ্বাস, শিল্পী সিদ্দিকুর রহমান, কবি দিলীপ ঘোষসহ কিছু স্থানীয় বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন, আমিও যুক্ত হলাম। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা একসঙ্গেই থাকলাম। হাসি হলো, রসিকতা হলো, ঢাকায় ফেরার জটিলতা ও পাটুরিয়া ঘাটের জ্যাম নিয়ে কথাবার্তা হলো। ৮ তারিখ রাতে ঝিনাইহে আমাদের শেষ আড্ডা হলো কবি সুমন শিকদার সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘বেগবতী’ প্রকাশনীর অফিসে। ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কবি ও নজরুল গবেষক বি এম রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে কথা বলেছেন স্থানীয় গুণীজনেরা। কথা বলেছি আমিও, কথা বলেছেন আপনিও। আপনার কথা মানেই তো সেই মুখে হাসি রেখে দু–একটা বাক্য বিস্তার। আমার ভাগনি তাথৈ ছবি তুলল। আমার সঙ্গে থাকা শিল্পী ও নির্মাতা প্রশান্ত অধিকারীসহ আপনি—আমরা তখন সেখানে চারুকলার তিনজন। খুব আনন্দের স্মৃতি। অনুষ্ঠান শেষে আমরা হাটখোলা ‘বেগবতী’ অফিস থেকে বেরিয়ে পায়রা চত্বরের দিকে হাঁটলাম। আপনি ও কাজল বিশ্বাস চলে গেলেন। খুব স্বাভাবিক সেই সময়টুকু। ভাবতেই পারিনি, দুই দিন বাদেই আপনাকে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলব।
এখন আপনার করা শিল্পকর্মগুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনী হওয়া খুব দরকার। শিল্পী জোয়ারদার মাহমুদকে আমরা এত সহজে বিস্মৃত হতে পারব না।
প্রিয় পল্টু ভাই, অনেক স্মৃতি। শুধু মন খারাপ করে বসে আছি। খুব মন খারাপ আজ। খুলনা, ঝিনাইদহ বা ঢাকায় আপনাকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না! অসমাপ্ত থেকে গেল জীবনের অনেক কিছুই।