ঝিনাইদহের ১২ সহ দেশে বিলুপ্ত ৭৭জাতের ধান চাষ শুরু
আব্দুর রহমান মিল্টন, ঝিনাইদহের চোখ
দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে প্রতিবছরই নতুন নতুন ধানের চাষ করা হচ্ছে সরকারী- বে-সরকারী উদ্যোগে। বিপরীতে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃৃতিক বান্ধব হাজারো জাতের দেশি ধান । কয়েক বছরের ব্যবধানে এই ধান গুলোর জায়গা দখল করে নিয়েছে উফশী ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান। ফলন বেশী হওয়ায় কৃষকেরাও ঝুঁকছে নতুন নতুন জাতের ধান চাষের দিকে ।
তবে আশার কথা হলো সার, সেচ ও পরিচর্য কম লাগা প্রকৃতি বান্ধব হারিয়ে যাওয়া এমন ৭৭ জাতের ধান চাষ শুরু হয়েছে দেশে। এর মধ্যে ঝিনাইদহ অঞ্চলের ১২ প্রকার ধানের জাত রয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২’শ জাতের বেশী জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ ও পর্যায়ক্রমে চাষ করে রাজশাহীর তানোর উপজেলার কৃষক ইউসুফ মোল্লা রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি সাফল্য দেখিয়েছেন । তার সংগ্রহেই আছে ঝিনাইদহের ১২ প্রজাতির ধান, এবার তিনি এসব দিয়ে ৭৭জাতের ধান চাষ করছেন।
বাদশাভোগ ,কালোজিরা,পাইজাম, কাশিয়া, বিন্নি, বাঁশমতি, জামাই ভোগ, দাদখানি, খৈয়া মটর. সুবাশ, চিনি শঙ্কর, যুবরাজ, সাদাকথা, রাধুনি পাগল, পাঙ্গাস, ঝিঙ্গাশাইল সহ বিভিন্ন জাতের সুগন্ধি চিকন চাল দিয়ে তৈরী হত খিচুড়ি সিন্নি-পায়েশ, ফিরনি ও জর্দা সহ আরও অনেক মুখরোচক খাবার। গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল এসব ধান কিন্তু এসবই এখন কালের স্মৃতি।
রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের বাসিন্দা কৃষক ইউসুফ মোল্লা। তিনি গত বছর ৫২ জাতের ধান চাষাবাদ করেছিলেন। চলতি মৌসুমে বীজের পরিধি বাড়াতে তা বাড়িয়ে ৭৭ জাতের ধান চাষ করেছেন মাঠে। এর মধ্যে ঝিনাইদহ অঞ্চলের রয়েছে ১২ জাতের ধান। এতো রকম জাতের ধান একসঙ্গে চাষাবাদ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কৃষক পর্যায়ে ইউসুফ মোল্লাই প্রথম স্থানে আছেন বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
কৃষক ইউসুফ মোল্লার ব্যক্তি উদ্যোগে এসব বিলুপ্ত ধানের বীজ দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষরণ করে রাখছেন। ২০১২ সাল থেকে রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুরসহ সারাদেশে প্রায় ৩০০ কৃষককে তিনি এসব বীজ শর্তসাপেক্ষে সবরাহ করেছেন। এছাড়া ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকায় ১০০ এর বেশি ও রাজশাহী গবেষণাগারে প্রায় ৬৫ জাতের ধান বীজ সরবারহ করেছেন।
আদর্শ কৃষক হিসেবে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। তার প্রচেষ্টায় বিলুপ্তি প্রায় ২০০ বেশি ধানের বীজ সংরক্ষেণে আছে। ইউসুফ মোল্লা সাংবাদিকদের জানান, পরিবেশ বান্ধব সুগন্ধি এসব ধান অল্পদিনেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরেই তিনি গত বিশ বছর ধরে বীজ সংগ্রহের কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত ২০০ এর বেশি বিভিন্ন জাতের ধান বীজ তিনি সংগ্রহ করেছেন। ২০১২ সাল থেকে ৫০টি করে জাতের ধান তিনি অল্প করে আবাদ করেন। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগ্রহী কৃষকদের মাঝে বিতারণ করছেন। তিনি আরো জানান, তিনি যে সব কৃষকদের এবস হারানো ধানের বীজ সরবরহ করছেন তা শর্তসাপেক্ষে। তা হলো বীজের বদলে বীজ। একজন কৃষক তার কাছে ৫ কেজি বীজ নিলে ধান উৎপাদনের পরে সে আবার ৫ কেজি বীজ ফেরত দিবে।
কৃষক ইউসুফ মোল্লা বলছেন, তার সংগ্রহে থাকা ১০০ প্রজাতির বেশি বীজ গাজীপুর ধান গবেষণা কেন্দ্র ও রাজশাহী ধান গবেষণা কেন্দ্রে ৬৫ রকম বীজ দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে ৭২ ঝিনাইদহ ১২ প্রকার জাতের ধান সরবরহ করেছেন। তারা সেগুলোর বিস্তার করা নিয়ে গবেষণা করছে। তার এমন উদ্যোগে উৎসাহ জোগাচ্ছেন স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ ও বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। আর সার্বিক সহযোগিতা করছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বারসিক।
রাজশাহীর তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কৃষক ইউসুফ মোল্লার ২০ বছরের প্রচেষ্টায় বরেন্দ্র থেকে অনেক নামী দামি বিলুপ্তি ধানগুলো নতুন করে জীবন পাচ্ছেন। তিনি রাজশাহী তথা বরেন্দ্রঞ্চলের সুনাম ধরে রেখেছেন। তাছাড়াও বিলুপ্তি ধান সর্ম্পকে নতুন প্রজন্মরা জানতে পারছেন।
গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী বিঘা প্রতি অন্য জাতের ধান যেখানে ১৫ থেকে সবোর্চ্চ ২০ মণ উংপাদন হয় সেখানে এসব জাতের ফলন হয় সর্বচ্চ ৮-১০ মণ পর্যন্ত। তবে দিগুন দাম পাওয়া যায় বাজারে। সার, সেচ ও পরিচর্যাও লাগে কম। সেই হিসেবে আবাদে লোকসান হয় না বললেই চলে । এখনও গ্রামের গৃহস্থ পরিবারের কাছে এ ধানের কদর যথেষ্ট। এ জাতের ধান আগে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আবাদ হত। কিন্তু এসব ধানের উৎপাদন কম হওয়ায় কৃষকরা বীজ আমদানীর উপর নির্ভশীল হয়ে পড়েন। কৃষকরা জানান, এজাতের ধান আবাদে প্রয়োজনীয় সহযোগীতা বা প্রদর্শনী প্লট প্রকল্প গ্রহণ করলে বিলুপ্তির হাত থেকে তা ফেরানো সম্ভব হবে।