কালীগঞ্জটপ লিড

হাঁসে হাসে ঝিনাইদহের আশরাফ

#সাবজাল হোসেন, ঝিনাইদহের চোখঃ

৩০ বছর লেবার সর্দারের কাজ করেছেন। সেখানে বছরে ৬ মাস কাজ থাকতো আর ৬ মাস থাকতে হতো বসে। ফলে সে সময়ে সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। কাজেই বাড়িতে বসে অন্য কোন কাজের কথা সব সময় ভাবতেন। কিন্ত কি করবেন ভেবে উঠতে পারছিলেন না। হঠাৎ একদিন টিভির পর্দায় দেশের এক বেকার যুবকের হাঁস পালনের সফলতার প্রতিবেদন দেখে তিনি নিজেও উৎসাহিত হন। এরপর মনস্থির করেন নিজ বাড়িতেই হাঁস পালন করবেন। আশা অনুযায়ী তিনি বাড়িতে হাঁস পালন করে ২ বছরের মধ্যেই আগের দিন পাল্টে ফেলেছেন। এমন সফলতা পাওয়া মানুষটির নাম আশরাফ হোসেন। তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌর এলাকার উত্তর কলেজপাড়ার বাসিন্দা।

সরেজমিনে আশরাফ আলীর বাড়িতে গেলে দেখা যায়, উঠানসহ ঘরের চারপাশে হাঁসে নানা স্বরে ডাকাডাকি করে বাড়ি মাথায় করছে। হাঁসগুলোর মধ্যে কিছু কিছু পাত্রে ছিটানো খাবার খাচ্ছে, কিছু শুয়ে বিশ্রামে আছে। আবার কিছু সারিবদ্ধভাবে ঝিলের পানিতে মনের আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে বেশির ভাগই পানি থেকে ডাঙায় উঠে খাবার না পেয়ে তাদের মালিকের চারপাশে ঘুরছে আর ব্যতিক্রমী এক শব্দ করে ক্ষুধার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আশরাফ আলী জানান, তার সাইদুর ও রাকিব নামের ২ ছেলে আছে। তারা মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়া করে। আর মেয়ে সোনিয়ার বিয়ে দিয়েছেন। নিজে একজন গরীব মানুষ। প্রায় ৩০ বছর ধরে মাথায় মালামালের বস্তা টেনে গাড়িতে উঠানো নামানোর কাজ করে সংসার চালিয়েছেন। কিন্ত এখন বয়স বেড়ে যাওয়ায় বোঝা বহনের কাজ করতে তার খুব কষ্ট হতো। তাই সব সময় পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবতেন। টেলিভিশনে একদিন এক হাঁস খামারীর সফলতার গল্প শুনে নিজে উৎসাহিত হয়ে এখন হাঁসের খামার করেছেন। প্রতিদিন যে ডিম পাচ্ছেন তা বিক্রি করে ভালই চলছে তার সংসার।

আশরাফ হোসেন জানান, তার বসতবাড়ির পাশেই রয়েছে নিচু জমির ঝিল। সেখানে কোন ফসলই ভালো হয় না। তবে হাঁস চরে বেড়ানোর মত উপযুক্ত স্থান। এটা মাথায় রেখেই জমির মালিকদের সাথে কথা বলেন। তাদেরকে প্রতিবছর বিঘা প্রতি ৭ হাজার টাকার চুক্তিতে ৫ বছরের জন্য ৮ বিঘা জমি বর্গা নেন। এরপর প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ করে ২০১৬ সালের নভেম্বরে বাসা বাড়ির সামনে বাঁশের চটার মাচং এবং গোলপাতার ছাউনির দুটি লম্বা সেটের ঘর নির্মান করেন। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে তিনি প্রতি পিচ ১০০ টাকা দরে মোট ৩’শ পিচ বেলজিয়াম জাতের হাঁসের বাচ্চা কেনেন। এর আড়াই মাস পরে প্রতিপিচ ৩০ টাকা দরে মোট ৪’শ পিচ খাকি ক্যাম্বেল জাতের হাঁসের বাচ্চা পাবনার চাটমোহল হ্যাচারী থেকে কিনে পালন করতে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় শতাধিক হাঁস মারা গেছে। বর্তমানে হাঁসগুলো ডিম দিচ্ছে। প্রতিদিন সাড়ে ৩’শ থেকে ৪’শ ডিম পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, হাঁসগুলো সকালে ঘর থেকে ছেড়ে দিলেই পাশের ঝিলের পানিতে গিয়ে নামে। সেখানে ইচ্ছামত গোসল ও দৌড়াদৌড়ি করে সকাল ১০ টার দিকে বাড়ির দিকে ধাওয়া করে। তাদের ডাকাডাকির পর বোঝা যায় তারা খাবার চাচ্ছে। এরপর তাদের কে চালের কুড়া, কিছু ধান, খুদের ভাত ও স্বচ্ছ পানির মিশ্রন করে খাবার দিতে হয়। প্রতিদিন হাঁসগুলোকে ২ বার খেতে দিতে হয়। গত দেড় মাস আগে নতুন আরেকটি সেট তৈরী করে আরও ৩’শ পিচ খাকি ক্যাম্বেলের বাচ্চা কিনে পালন করছেন।

আশরাফ জানান, এখন তার ছোট বড় মিলে মোট প্রায় ৯’শ হাঁস রয়েছে। প্রতিদিন খাবার বাবদ ১ হাজার আর গড়ে প্রতিদিন ঔষধ বাবদ ২,শ টাকা মিলে মোট ১২’শ টাকা খরচ হচ্ছে। তবে সকাল হলেই ডিম পাচ্ছেন কোন দিন সাড়ে তিন’শ থেকে আবার কোনদিন ৪’শতয়ের কাছাকাছি। বাজারে প্রতিপিচ ডিম ১০ টাকায় বিক্রি করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ করেছেন। কিন্ত ডিম বিক্রি করেছেন কমপক্ষে ১২ লাখ টাকার। এখন হাঁসের খাবার ও ঔষধ খরচ ছাড়া নতুন করে তেমন একটা খরচ নেই। প্রতিদিনের ডিম বিক্রির টাকায় দায়দেনা পরিশোধ করছেন। সুন্দরভাবে সংসার চালাচ্ছেন। আর বাকিটা জমা করছেন।

আত্বপ্রত্যয়ী মানুষ আশরাফ জানান, এটাতে পরিশ্রম বেশি না। তবে সব সময় নজর রাখতে হয়। স্ত্রী নারগিছ বেগম সব সময় তার কাজে সহযোগিতা করে থাকেন। হাঁসের রোগ ব্যাধি অন্যান্য পশু পাখির চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম কিন্ত দু একটি আক্রান্ত হলে দ্রæত সক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সে কারনে সময় তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে হয়। তিনি বলেন হাঁস বেশি আক্রান্ত ডাকপ্লেগ ও কলেরা রোগে। এগুলোর ঔষধ হাসপাতাল থেকেই বিনামূল্যে পেয়ে যান। আর অন্যগুলো বাজার থেকে কেনা লাগে।

ঝিলের ধারের বর্গা নেয়া জমিগুলোর মধ্যে ২ বিঘা জমি হতে বোরো মৌসুমে বেশ ধান পান। যা তার সংসারের সারা বছরের চালের চাহিদা মেটায়।

আশরাফ হোসেনের স্ত্রী নারগিছ বেগম জানান, হাঁস বর্ষার সময়ে একটু বেশি জায়গা নোংরা করে। আর রোগ শুরু হলে যখন মারা যায় তখন মন কেঁদে যায়। তাছাড়া হাঁস পালন করা কঠিন কোন কাজ নয়। মনের একটা সখও পুরন করা যায়। তিনি বলেন, সকালে ঘর খুলে যখন ডিম পাওয়া যায় তখন ভালোই লাগে। আবার সকালে ঘর থেকে ছেড়ে দিলে যখন সারিবদ্ধভাবে ঝিলের দিকে দৌড় দেয় আবার ক্ষুধায় যখন সারিবদ্ধভাবে বাড়ি ফিরে নিজেদের আশপাশে খাবারের জন্য আবেদন জানায় তখন খুব ভালো অনুভব হয়। তিনি বলেন, এক সময় সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। এখন সেদিন পার করতে পেরেছেন। হাঁসগুলো সুস্থ থাকলে বেশ লাভবান হতে পারবেন। যা তারা কখনও কল্পনাও করেননি।
নারগিছ বেগম আরও বলেন, প্রথমদিকে পরের নিকট থেকে ধারদেনা ও সংসারের সবকিছু বিক্রি করে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েছিলেন। প্রথম দিকে ভয় অনুভব হতো। কিন্ত এখন সব কিছু বুঝে গেছেন। তিনি বলেন,সরকারীভাবে স্বল্প সুদে ঋন পেলে আরও বড় করে হাঁসের খামার গড়ে তোলার আশা আছে তাদের।

কালীগঞ্জ উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ আতিকুজ্জামান জানান, আশরাফ হোসেনের হাঁসের খামার তিনি দেখেছেন। তিনি খুব আশাবাদী ও পরিশ্রমী একজন মানুষ। এছাড়াও তার বাড়ির পাশে ঝিল থাকায় হাঁস পালন করা খানিকটা সহজ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আশরাফের খরচের পর্ব শেষ হয়েছে এখন তার প্রতিদিন ডিম আসছে। অর্থাৎ এখন তার লাভের পালা। তিনি বলেন, আশরাফ হোসেন যখন তার কাছে আসেন সাধ্যমত তার সমস্যা সমধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button