সাইকেলে করে স্বপ্ন ফেরি করা ঝিনাইদহের সাব্বিরের গল্প
বয়সের হিসেবে সাব্বির তখনো শৈশব পেরোয়নি। একবার তাদের গ্রামে ঘুরতে এলেন এক বিদেশি পর্যটক। গ্রামে গিয়ে পর্যটক জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাংলাদেশ আসলে দেখতে কেমন?’ তখন গ্রামের একজন উত্তরে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ দেখতে এই গ্রামের মতোই।’ কথাটা অনেকটা রহস্যের মতো লাগে সাব্বিরের কাছে। আর এই রহস্যই একসময় পরিণত হয় কৌতূহলে। তখন থেকেই সাব্বির ভাবতে শুরু করেন, ‘বাংলাদেশ আসলে দেখতে কেমন?’ এই ভাবনা থেকেই একসময় সাব্বির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন একদিন সাইকেলের চাকায় ভর করে নিজেই ঘুরে দেখবেন পুরো বাংলাদেশ। দেশের প্রতিটি জেলার মাটিতে আঁকবেন তার দুরন্ত পায়ের ছাপ।
স্বপ্নের শুরুটা ঠিক এভাবেই। প্রথম শোনায় খানিকটা অসম্ভব বলে মনে হলেও মোহাম্মদ সাব্বির হোসেনের সংগ্রামটা ছিল আরও অনেক বেশি কঠিন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না থাকায় সাইকেল কেনার সামর্থ্য ছিল না তার। তাই স্বপ্নটা যেন থেকে থেকেই খাবি খাচ্ছিল তার মনে। এরমধ্যেই বড় ভাই মোহাম্মদ সাগর হোসেন অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পেয়ে যান। বৃত্তির টাকা দিয়ে বড় ভাই একটি সাইকেল কিনলে তার হাত ধরেই সাইকেল শিখতে শুরু করেন সাব্বির। এরপর সময় পেলেই তিনি বেরিয়ে পড়তেন সাইকেল নিয়ে। কখনোবা যেতেন বাড়ির আশপাশে, কখনোবা আবার দশ-বিশ কিলোমিটার দূরে আত্মীয়ের বাসায়।
দেখতে দেখতেই সাব্বির পার করে ফেলেন তার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাজীবন। এরপর ভর্তি হন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্যবিজ্ঞান অনুষদে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দীর্ঘ দুই বছর পর বাবা-মা ও বড় ভাইয়ের টাকা একত্রিত করে একটি সাইকেল কিনে ফেলেন সাব্বির। এরপর সময় পেলেই সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে বেরিয়ে পড়তেন আশপাশের বিভিন্ন জেলায়। এভাবেই দেখতে দেখতে বিশটি জেলা ঘুরে ফেলেন সাব্বির।
খানিকটা পাগলাটে স্বভাবের হলেও নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি সাব্বির। একদিন হঠাত্ করেই তিনি চিন্তা করেন, ‘যেহেতু সাইকেলে করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছি, তাই সাইকেলের সামনে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্ল্যাকার্ড লাগালে মানুষজনকে সচেতন করা যাবে।’ আর এই ভাবনা থেকেই তিনি সাইকেলের সামনে বাংলাদের বিভিন্ন চলমান সমস্যার প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে ঘুরতে শুরু করেন। এসব প্ল্যাকার্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার চাই’, ‘ধর্ষণকে না বলুন’, ‘পরিবেশদূষণ রোধ করি’ ইত্যাদি। আর সাইকেলের পিছনে সবসময় ছিল একটি কথা ‘স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ’।
২০১৭ সালের প্রথমদিকে শুরু হওয়া এই যাত্রার সমাপ্তি ঘটে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর, দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে। মাগুরা জেলা দিয়ে শুরু হয়ে সাব্বির তার সর্বশেষ পদচিহ্ন আঁকেন কক্সবাজার জেলায়। এসময় তার সাইকেলের সামনের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নাও’। স্বপ্ন পূরণের এই পথচলাটা মোটেই সহজ ছিল না তার পক্ষে। অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা প্রতিটা মুহূর্তে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল বিশাল এক পর্বতরূপে। কখনোবা এক বেলা না খেয়ে আবার কখনোবা দুই বেলা না খেয়ে টাকা বাঁচিয়েছেন তিনি। নতুন নতুন জেলায় গিয়ে রাত কাটিয়েছেন চায়ের দোকানে। কিন্তু সাব্বিরের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও স্পৃহার কাছে হার মানতে হয়েছিল এ সবকিছুকেই।
সাইকেলের চাকায় পুরো বিশ্ব ঘুরে দেখার স্বপ্ন বুকে পুষে রাখা এই তরুণ বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্যবিজ্ঞান অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। সাইকেলে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও তাদের সচেতন করতে পারাটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর্থিক সহযোগিতা পেলে সামনে ভুটানে যাওয়ার ইচ্ছা আছে সাব্বিরের।
সুত্র: ইত্তেফাক