হামিদুর রহমান কেবল যুদ্ধের মাঠে অস্ত্র হাতে ছুটে চলা নিছক এক গেরিলা নন, চমক লাগানো কোনো সাহসী বীরের গল্পে সীমাবদ্ধ নয় তাঁর জীবন। তাই আমাদের নিজেদের কাছে আবারও এই প্রশ্ন রাখতে হয়, কে এই হামিদুর রহমান? কোথায় তাঁর জন্ম? কীভাবে তিনি বেড়ে উঠলেন? কোন প্রেরণায় তিনি আত্মত্যাগ করলেন? এ যেন বাংলাদেশেরই অন্য এক অনুসন্ধান। কিংবা অন্য অর্থে আমাদের নিজেদের ভেতরেরই এক অনুসন্ধান।
আমরা জানি, দেশের সেই কনিষ্ঠ বীরসন্তান সিপাহি হামিদুর রহমানকে, যাঁর জন্ম হয়েছিল বাবা আক্কাস আলী মণ্ডল আর মা কায়েদাতুন্নেসার সংসারে, ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খর্দ্দ খালিশপুর গ্রামে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তাঁর বাবা-মা নিজের পিতৃপুরুষের ভিটা ভারতের চব্বিশ পরগনা ছেড়ে একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় এসেছিলেন এদেশে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে। স্বপ্নের সেই দেশে তাঁর বাবা আক্কাস আলী মণ্ডল ছিলেন দরিদ্র এক দিনমজুর। এই সামান্য জীবন থেকেই অসামান্য হয়ে উঠলেন মাত্র ১৮ বছর বয়সের সদ্য কৈশোর পেরোনো হামিদুর রহমান। হয়ে উঠলেন বীরশ্রেষ্ঠ, দেশের গৌরব।
নতুন দেশে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি তাঁদের। বড় ছেলে হামিদুর রহমানকে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করে বাবার সঙ্গে দিনমজুরিতে নেমে যেতে হয়। হামিদুর ভর্তি হন নৈশ স্কুলে। শত দারিদ্র্য ও কঠিন শ্রমের বিনিময়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। অসম্ভব মানসিক শক্তি থাকলেই কেবল এভাবে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়। পূর্ব পাকিস্তানের আরও বহু মানুষ ছিলেন তাঁদেরই মতো ভাগ্যহত। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যায় শোষণ আর অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকেই মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছিল, শুধু ধর্মের নামে দুটি ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির মানুষের সব বৈষম্য চাপা দিয়ে রাখা যায় না। এই উপলব্ধি হয়তো হামিদুর রহমানেরও ছিল। তিনি মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। জীবনের মায়া ত্যাগ করে শত্রুর মুখোমুখি হতে পেরেছেন।
১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হামিদুর রহমান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। তখন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বাধিকার আন্দোলনে উত্তাল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলের নিরঙ্কুশ জয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণের এক রাজনৈতিক পদক্ষেপ। কিন্তু সেই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির হীন মানসিকতা এ দেশের মানুষের মনে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ত্বরান্বিত করে। ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণকে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবেই নিয়েছিল, সারা দেশ তখন উত্তপ্ত। সেই সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন হামিদুর রহমান। তখনো কি তাঁর ভাবনায় ছিল অতি নিকটেই অপেক্ষা করছে কোনো যুদ্ধের হুইসেল?
২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়ে যায় গণহত্যা। সেই রাতেই ১ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আরও কিছু ইউনিট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। হামিদুর রহমান ছুটে যান মায়ের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু তিনি কোনো কালক্ষেপণ করেন না, আবার ফিরে আসেন মুক্তিযুদ্ধে। শুধু পরিবারের জন্য যে জীবনযুদ্ধ তিনি শুরু করেছিলেন, তা ছাপিয়ে তাঁর যুদ্ধ শুরু হয় দেশমাতৃকার জন্য। এবার এক বৃহত্তর ভালোবাসার ডাকে বেরিয়ে পড়লেন হামিদুর রহমান।
তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিপাহি। সম্ভাব্য কোনো যুদ্ধের জন্যই দীক্ষিত করা হচ্ছিল তাঁকে। হয়তো তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে পাকিস্তানি সেনা হতেন, কিন্তু তা তিনি হতে পারেননি। সময়ের প্রয়োজনে বেছে নিতে হয় সমরনীতি। তবে কি ইতিহাসের করতলই ছিল তাঁর উৎস? কোন সে ইতিহাস? দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া দেশ? হামিদুর রহমানের বাবা তো ভূমিহীন হয়েই এসেছিলেন এ দেশে। ধর্ম এক অন্তরতম বিশ্বাস। কিন্তু এই বাস্তব জীবনের সবকিছুই তো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রাজনীতির হাতে। এই ধর্মকে যারা ইতিহাসে ভেদ সৃষ্টি করতে কিংবা রাজনীতিতে বৈষম্য টিকিয়ে রাখতে ব্যবহার করছে, তারা কি মানুষের চিরশত্রু নয়? হামিদুর রহমান জানতেন সে ইতিহাস। তাঁর নিজের জন্মভূমি এই বাংলা। তিনি জানতেন, মানবিকতার ইতিহাস, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, মাতৃভাষা রক্ষায় বাঙালি জীবন দিয়ে দেয়। এসব জীবন ও সংস্কৃতির অনুভবে বেড়ে উঠেছিলেন এই কিশোর। হয়তো সংস্কৃতির ইতিহাস তাঁকে পথ চিনতে শিখিয়েছে, তাই তো তিনি অবতীর্ণ হলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিসেনা হয়ে। ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার বিরুদ্ধেই ছিল তাঁর এই যুদ্ধ।
হামিদুর রহমান ছিলেন জেড ফোর্সের অধীন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য। অক্টোবর মাস, মুক্তিবাহিনী ঠিক করেছিল সিলেটের শ্রীমঙ্গল থেকে ১০-১২ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ভারতের সীমান্তবর্তী আউটপোস্ট ধলই দখলের। টিলা ও চা-বাগানবেষ্টিত, জলা-জংলায় সবুজ সেই জায়গা। সেই প্রান্তে পাকিস্তানি সীমান্তঘাঁটি দখলের পরিকল্পনা নেন মুক্তিযোদ্ধারা। ২৭ অক্টোবর মধ্যরাত থেকেই পাহাড়ি পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন তাঁরা। হামিদুর রহমান ছিলেন এই দলেরই একজন। জায়গাটা ছিল দুর্গম। ২৮ অক্টোবর, প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। পাকিস্তানি বাহিনীর মেশিনগান আর মর্টার মুহুর্মুহু গর্জে উঠছে। পরিস্থিতি তখন ভয়ানক, মুক্তিবাহিনীর পরাজয় ও মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দেয়। তখন হামিদুর ছিলেন দলপতি লেফটেন্যান্ট (পরে মেজর) এম এ কাইয়ুম চৌধুরীর পাশে। তিনি হামিদুরকে দেখালেন একটি মেশিনগান পোস্টের অবস্থান। ওই মেশিনগান পোস্টটি ধ্বংস করতে পারলেই কেবল এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব। আর তা না করতে পারলে শেষ হয়ে যাবেন মুক্তিবাহিনীর এই গেরিলারা। তিনি হামিদুরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন দুটি গ্রেনেড। হামিদুর রহমান দীপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘করে দেব, স্যার।’ তারপর সেই নালার মধ্য দিয়ে ক্রলিং করে হামিদুর এগিয়ে চললেন শত্রুর মেশিনগানের দিকে।
আধো আলো আধো অন্ধকারে হামিদুর সম্মুখসমরে মেশিনগান পোস্টটির কাছাকাছি। সেখানে দুজন পাকিস্তানি সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপর। শুরু হলো হাতাহাতি যুদ্ধ। সেই রক্তাক্ত লড়াইয়ে আহত অবস্থার মধ্যেই তিনি মেশিনগান পোস্টটি ধ্বংস করলেন। এরপর তিনি ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। পাহাড়ি নালার পানিতে ভেসে গিয়েছিল তাঁর রক্ত, মগজের কিছু অংশ। সেদিন এই আত্মত্যাগের বিনিময়ে তিনি অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তাঁর বীরোচিত আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে পরবর্তী লড়াইয়ে বিজয়ের পথ সুগম হলো।
সিপাহি হামিদুর রহমানের শারীরিক মৃত্যু হলো, কিন্তু তিনি অমর হয়ে রইলেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান হয়ে। মাত্র ১৮ বছরের জীবনে হামিদুর সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, রক্তের অক্ষরে বাংলাদেশের ইতিহাসে লিখে গেলেন নাম। সহযোদ্ধারা চোখের জলে তাঁকে সমাহিত করেছিল ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাসা গ্রামে।
বাংলাদেশ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে ভুলে যায় না, ভুলে যেতে পারে না। দেরিতে হলেও ২০০৭ সালে দেশের সর্বকনিষ্ঠ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনা হয় স্বাধীন দেশে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে তাঁকে সমাহিত করা হয় স্বাধীন জন্মভূমির মাটিতে।