অন্যান্য

দশ মাসেই কোটিপতি তিনি!

>> নগদ ৪৪ লাখ টাকাসহ ধরা খান জেলার সোহেল রানা
>> পৃথক দুই মামলায় রিমান্ড মঞ্জুর
>> জনমনে প্রশ্ন, চট্টগ্রাম কারাগার কি টাকার গাছ

২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার হিসেবে যোগ দেন সোহেল রানা বিশ্বাস। সে হিসাবে বছর শেষ হতে এখনও দু’মাস বাকি। মাত্র দশ মাস আগে নরসিংদী কারাগার থেকে বদলি হয়ে আসা সোহেল রানা এখন কোটিপতি!

গত শুক্রবার (২৬ অক্টোবর) নগদ ৪৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা এবং প্রায় পাঁচ কোটি টাকার নথিপত্রসহ ভৈরব রেলওয়ে পুলিশের হাতে আটক হন জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস। ওই ঘটনায় ভৈরব থানার এসআই আশরাফ উদ্দিন ভূঁইয়া বাদী হয়ে শনিবার বিকেলে মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে সোহেল রানার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেন।

সোমবার সকালে আদালতে হাজির করে তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। দুপুরে শুনানি শেষে কিশোরগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইকবাল মাহমুদ দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশের কাছে সোহেল রানা দাবি করেছেন, এসব টাকার সবটাই তার নয়, এতে ভাগ রয়েছে তারই দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার। যা আগামী ১ নভেম্বর ঢাকার কাশিমপুর কারাগারে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জেলার সম্মেলনে ভাগ-বাটোয়ারার কথা ছিল। স্বভাবতই সাধারণের মনে প্রশ্ন উঠছে, তবে কি চট্টগ্রাম কারাগার টাকার গাছ!

কারা সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী কয়েদি ও হাজতিদের খাবার সরবরাহ, স্বজনদের সাক্ষাৎ, আমদানি ওয়ার্ডে বন্দী বিক্রি, মেডিকেলে অসুস্থের জায়গায় সুস্থদের রাখাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিময় হচ্ছে কোটি টাকার ঘুষ। বন্দীদের সংশোধন করতে কারাগার দেয়া হলেও সেটি এখন হয়ে উঠেছে টাকার গাছ। এমন পরিবেশে দশ মাস চাকরি করে কোটিপতি বনে গেছেন জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস। তাকে ম্যানেজ করেই ঠিকাদাররা বন্দীদের সরবরাহ করতেন পরিমাণে কম ও নিম্নমানের খাবার। সোহেল রানাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জোগসাজশেই বছরের পর বছর ঘুরেফিরে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে কারাগারে এ খাবার সরবরাহের কাজ।

রেলওয়ে পুলিশের ভৈরব থানার ওসি আবদুল মজিদ মোবাইলে জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসকে নগদ ৪৪ লাখ টাকাসহ আটক করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে তিন ঠিকাদারের প্রায় দেড় কোটি টাকার চেক উদ্ধার করা হয়। এছাড়া দুই কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর, এক কোটি ৩০ লাখ টাকার চেক, বিভিন্ন ব্যাংকের পাঁচটি চেক বই, একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা ও ১২ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করা হয়।’

তিনি আরও জানান, দুই কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর ঘেঁটে দেখা গেছে, এর মধ্যে এক কোটি টাকা সোহেল রানার নামে। এক কোটি আছে স্ত্রী হোসনে আরা পপির নামে। বাকি ৫০ লাখ টাকা শ্যালক রাকিবুল হাসানের নামে প্রিমিয়ার ব্যাংকে। চেকে দেয়া এক কোটি ৩০ লাখ টাকা ছিল সোহেল রানার নামে। যা তিনি ঘুষের টাকার চেক বলে স্বীকার করেছেন। চেকের টাকা উত্তোলনের তারিখ ছিল রোববার (২৮ অক্টোবর)। জব্দ চেক বইগুলো সোনালী, প্রিমিয়ার, সাউথইস্ট, মার্কেন্টাইল ও ব্র্যাক ব্যাংকের।

বিপুল অর্থসহ আটকের পরপরই পুলিশের কাছে জেলার সোহেল রানা দাবি করেন, জব্দ করা টাকার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা তার। বাকি ৩৯ লাখ টাকা কারা বিভাগের চট্টগ্রাম জোনের ডিআইজি পার্থ কুমার বণিক এবং চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিকের। ১ নভেম্বর ঢাকার কাশিমপুর কারাগারে জেলারদের সম্মেলন হবে। ওই সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগে তিনি পাঁচদিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন। ওই দুই কর্মকর্তা চট্টগ্রামেই থাকেন। সর্বশেষ দুই মাসের মাসোহারা তার কাছ থেকে চট্টগ্রামে না নিয়ে ঢাকায় গিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা।

southeast

তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি প্রিজন পার্থ কুমার বণিক বলেন, ‘সোহেল রানার বিরুদ্ধে আগে থেকেই অনেক অভিযোগ আছে। তিনি একজন মাদকাসক্ত। আমরা মৌখিকভাবে বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে ছিলাম। এখন নিজের পিঠ বাঁচাতে আমাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে।’

অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিকও।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, যেখানে অপরাধীদের সংশোধনের জন্য পাঠানো হয়, সেই কারাগারের জেলার একজন মাদকাসক্ত। যিনি নিয়মিত ফেনসিডিল সেবন করেন। ডিআইজি-প্রিজন ও সিনিয়র জেল সুপার বলছেন, বিষয়টি তারা সবাই জানতেন। এছাড়া চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে সিনিয়র জেল সুপার ও কারা সীমানায় ডিআইজি প্রিজনের অফিস রয়েছে। ওই দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেলার সোহেল রানার অপকর্মের বিষয়ে অবগত থাকলেও কাগজে-কলমে কখনও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কেন, সে প্রশ্নও উঠেছে।

জেলার সোহেল রানার আমলনামা

সোহেল রানা বিশ্বাস ময়মনসিংহ সদরের আর কে মিশন রোডের বাসিন্দা জিন্নাত আলী বিশ্বাসের ছেলে। ২০০১ সালে চাকরিতে যোগ দেন তিনি। ২০০৯ সালে সোহেল রানা বিশ্বাস ডেপুটি জেলার হিসেবে কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন। কিন্তু দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত জেলার হিসেবে। তার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে তিন মাসের মাথায় কয়েদি ও হাজতিরা একযোগে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন। তখন কর্তৃপক্ষ তাকে প্রত্যাহার করে নেয়।

২০১২ সালে ঢাকার ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দারকে মারধরের অভিযোগ ওঠে সোহেল রানার বিরুদ্ধে। মারধরের কারণ হিসেবে জানা যায়, গোলাম হায়দার সোহেল রানার বিরুদ্ধে একটি মামলার তদন্ত করছিলেন। সেই সূত্রে হামলার শিকার হন গোলাম হায়দার। ওই ঘটনার পর দীর্ঘদিন বরখাস্ত ছিলেন সোহেল রানা। পরে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পান তিনি। বদলি হন সাতক্ষীরা জেলা কারাগারে। সেখানে জেল সুপার নুরুন্নবী ভূঁইয়ার গলা টিপে ধরারও অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

২০১৫ সালে চুয়াডাঙ্গায় চাকরি করার সময় গণপূর্তের এক কর্মচারীকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে সোহেল রানার বিরুদ্ধে। চট্টগ্রামের আগে সর্বশেষ নরসিংদী কারাগারের জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।

২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার হিসেবে যোগ দেন সোহেল রানা। সবশেষ গত শুক্রবার (২৬ অক্টোবর) নগদ ৪৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকাসহ প্রায় পাঁচ কোটি টাকার নথিপত্রসহ ভৈরব রেলওয়ে পুলিশের হাতে আটক হন তিনি।

কারাগারের কালো জগত

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মাসে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা অবৈধ আয় হয়। কারাগারের বন্দিবিক্রি, স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, পুনঃগ্রেফতারের হুমকিসহ নানাভাবে তোলা হয় এ টাকা। গ্রেফতার জেলার সোহেল রানা ও তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বন্দি এবং তাদের স্বজনদের জিম্মি করে চট্টগ্রাম কারাগারকে টাকার গাছে পরিণত করা হয়। টাকা আদায়ের নামে কারাবন্দি ও কারারক্ষী সবার ওপর চালানো হয় নির্যাতনের স্টিমরোলার।

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে একাধিক আয়ের উৎস। সেগুলো হচ্ছে- কারাগারে আগত নতুন বন্দিদের নিলামে বিক্রি, টাকার বিনিময়ে বন্দির সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাৎ। দর্শনার্থীদের সামর্থ্য অনুযায়ী নানাভাবে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। যেমন- জানালা সাক্ষাৎ, গেট সাক্ষাৎ, ভিআইপি সাক্ষাৎ ইত্যাদি। এছাড়া জামিনপ্রাপ্ত বা সাজা খেটে বের হওয়া বন্দিদের কারা ফটকে পুনরায় গ্রেফতারের হুমকি, কারাগারের ক্যান্টিন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, কারা হাসপাতালে অসুস্থ হিসেবে বন্দিদের সুবিধা পাইয়ে দেয়ার নামেও আদায় হয় মোটা অঙ্কের টাকা।

এসবের পাশাপাশি, বন্দীদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহের সুযোগ দিয়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া, কারাগারে গড়ে তোলা ডেইরি ফার্মের দুধ বিক্রিসহ নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় হয়। যা ভাগবাটোয়ারা হয় কারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপর থেকে নিচের মহলের পকেটে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button