ধর্ম ও জীবন

হাশরের ময়দানে শাফায়াত অনুষ্ঠিত হবে যেভাবে

হজরত ইসরাফিল আলাইহিস সালামের শেষ ফুৎকারে সারা দুনিয়ার সব মানুষ জীবিত হয়ে ওঠবে। যে যেখানে মারা গেছে কিংবা ধ্বংস হয়েছে অর্থাৎ কবর থেকে স্মশান থেকে সাগর থেকে পাহাড় থেকে তারা ওঠে কেয়ামতের ময়দানে একত্রিত হতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘আর শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমানসমূহে যারা আছে ও জমিনে যারা আছে তারা সবাই বেহুশ হয়ে পড়বে, যাদেরকে আল্লাহ ইচ্ছা করেন তারা ছাড়া। তারপর আবার শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে তৎক্ষণাৎ তারা দাঁড়িয়ে দেখতে থাকবে।

আর জমিন তার রবের নূরে আলোকিত হবে, আমলনামা উপস্থিত করা হবে এবং নবি-সাক্ষীগণকে আনা হবে, তাদের মধ্যে ন্যয় বিচার করা হবে। এমতাবস্থায় যে, তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।’ (সুরা যুমার : আয়াত ৬৮-৬৯)

সিংগায় চূড়ান্ত ফুঁক দেয়ার পর হাশরের ময়দানে মানুষ হয়রান-পেরেশাণ হয়ে ঘর্মাক্ত অবস্থায় দিক-বিদিক ছুটতে থাকবে। হাদিসে এসেছে-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু বর্ণনা করেন, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল।লাম বলেন, শেষ ফুঁক দেয়ার পর আমিই হব প্রথম ব্যক্তি, যে তার মাথা ওঠাবে। আমি তখন দেখব যে, মুসা আলাইহিস সালাম আরশের খুঁটি ধরে দাাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানি না সে-কি আগে থেকেই (অর্থাৎ তাকে কি বেহুঁশ করা হয়নি) নাকি ফুঁক দেয়ার পর (তিনি ওঠেছেন)।’ (বুখারি ও মুসলিম)

হাশরের ময়দানে সব মানুষ মুক্তির জন্য আত্মহারা-পাগলপারা অবস্থায় সময় অতিবাহিত করবে। মুক্তির জন্য সুপারিশ লাভে থাকবে হয়রান পেরেশান। হাদিসে হাশরের ময়দানের সে পেরেশান থেকে মুক্তি লাভে শাফায়াত বা সুপারিশ লাভ সম্পর্কে হাদিসের একটি বর্ণনায় এসেছে-

‘যখন সব মানুষ ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে, তখন তারা পরামর্শ করে নবিদের কাছে সুপারিশের আবেদন করবে। প্রথমেই তারা হজরত আদম আলাইহিস সালামের কাছে যাবে। আর বলবে আপনি আমাদের পিতা। আপনি আমাদের জন্য সুপারিশ করুন।

হজরত আদম আলাইহিস সালাম বলবেন, আমি সুপারিশ করতে পারব না। বরং তোমাদের উচিত হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কাছে যাও। তখন সব মানুষ হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কাছে আসবে এবং সুপারিশের আবেদন করবে। তিনিও বলবেন আমি সুপারিশ করতে পারব না।

এভাবে হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে এক একজন নবির কাছে তারা যাবে এবং প্রত্যেকের কাছে তারা পরিস্কার জবাব (প্রত্যেকেই সাহায্য করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট অপরগতা প্রকাশ করবে।) পেয়ে ফিরে আসবে।

অবশেষে সব মানুষ হাশরের ময়দানে ভয়াবহতায় নিজেদের সাহায্য লাভের সুপারিশ নিয়ে বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পৌঁছবে। সেদিন তিনি ‘মাকামে মাহমুদ’ সর্বোচ্চ সম্মানের স্থানে অধিষ্ঠিত হবেন।

সব মানুষ প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলবেন, হে রাসুল! আপনি আমাদের সবার জন্য সুপারিশ করুন। তিনি উত্তর দিবেন, আমি প্রস্তুত আছি। আর আমিই তার (এ কাজের) অধিকারী।

অতঃপর তিনি (বিশ্বনবি আরশের কাছে) যাবেন এবং আরশের নিচে সেজদায় পড়ে যাবেন। (এমনভাবে) আল্লাহর প্রশংসা করবেন (যাতে মহান আল্লাহ খুশি হয়ে যাবেন)। তখন আল্লাহ বলবেন, হে মুহাম্মদ! আপনি (সেজদা থেকে) মাথা ওঠান।

(হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি যা বলবেন শোনা হবে। আপনি যাদের জন্য শাফায়াত বা সুপারিশ করবেন তা গ্রহণ করা হবে।

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদা থেকে মাথা ওঠিয়ে বান্দার ফয়সালার জন্য আল্লাহর কাছে আসবেন এবং বলবেন, হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতদেরকে ক্ষমা করে দেন।

আর আল্লাহ তাআলা তাঁর (বিশ্বনবির) সুপারিশ কবুল করবেন এবং মেঘমালার ছায়াতলে সমাগত হবেন।’

পরকালে কোনো অপরাধী আল্লাহর শক্তির নাগালের বাইরে যেতে পারবে না। তাদের শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহর ক্ষমতাই চূড়ান্ত। অন্য হাদিসে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল।রাম বর্ণনা করেন, একবার তিনি সুরা মায়েদার ১১৮নং আয়াত তেলাওয়াত করেন-
إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
অর্থ : ‘আপনি যদি তাদেরকে শাস্তি দেন তবে তারাতো আপনারই বান্দা, আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন (আপনাকে বাধা দেয়ার কেউ নেই) তবে আপনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’

অতঃপর আল্লাহর কাছে হাত ওঠালেন এবং দোয়া করলেন-
‘হে আল্লাহ! আমার উম্মত, আমার উম্মত এবং কাঁদালেন।’ তখন আল্লাহ জিবরিল আলাইহিস সালামকে বললেন মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে যাও এবং তাকে জিজ্ঞাসা কর, যদিও তিনি সব বিষয় ভালো জানেন; তিনি কেন কাঁদছেন?
জিবরিল আলাইহিস সালাম তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন আর রাসুলও তার উত্তর দিলেন। তখন আল্লাহ আবার বললেন, হে জিবরিল! মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে যাও এবং তাকে বল, ‘আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করে দেব; অসন্তুষ্ট করব না।’ (মুসলিম)

পরিশেষে…
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে হাশরের ময়দানের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে একটি দোয়া পড়ার নসিহত পেশ করেন। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিভাবে আমি শান্তিতে থাকব অথচ শিংগাওয়ালা (ইসরাফিল) শিংগা মুখে নিয়ে আছে। তার কপাল টান করে আছে এবং কান খাড়া করে আছে, অপেক্ষা করছে কখন তা ফুঁক দেয়ার নির্দেশ আসে আর সে ফুঁক দেবে।
তখন সাহাবারা বলল, হে আল্লাহর রাসুল! তাহলে আমরা কি বলব? তিনি বললেন, তোমরা বল-
حَسْبُنَا اللهُ وَ نِعْمَ الْوَكِيْل – تَوَكَّلْنَا عَلَى اللهِ رَبَّنَا
উচ্চারণ : ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল, তাওয়াক্কালনা আলাল্লাহি রাব্বানা।’
অর্থ : ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট; আর তিনি কতইনা উত্তম কর্মবিধায়ক, আমরা আমাদের রব আল্লাহর ওপরই ভরসা করছি।’ (তিরমিজি)

সুতরাং মুসলিম উম্মাহর উচিত, দুনিয়াতে আল্লাহর বিধি-বিধান যথাযথ পালন করা। হাশরের ময়দানের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে প্রিয়নবির শেখানো ভাষায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা আর প্রিয়নবির শাফায়াত লাভের কামনা করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হাশরের ময়দানে তার শাফায়াত লাভ করার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button