উদ্ভিদের সঙ্গে সুলায়মান (আ.) এর সংলাপ
![](https://i0.wp.com/jhc24.com/wp-content/uploads/2018/11/00-55.jpg?resize=750%2C470&ssl=1)
হজরত সুলায়মান (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইল বংশে আল্লাহর নবী। একই সঙ্গে দুনিয়ার বাদশা। মানব-দানব, পশুপাখির ওপরও তার রাজত্ব ছিল। তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে মসজিদুল আকসার প্রতিষ্ঠাতা। জিনরাও অংশ নিয়েছিল মসজিদুল আকসার নির্মাণকাজে। নির্মাণকাজ শেষ হলে তিনি রোজ সকালে মসজিদে যেতেন বিনয়াবনত হয়ে। একদিন লক্ষ করলেন, মসজিদের আঙিনায় নতুন নতুন উদ্ভিদ জন্মায়। তিনি উদ্ভিদের কাছে গিয়ে জানতে চাইতেনÑ তোমার নাম, পরিচয়, গুণাগুণ কী। কোন রোগে কী কাজ কর। কার কতটুকু উপকার বা অপকার কর? উদ্ভিদ আল্লাহর নবীর কাছে প্রকাশ করত নিজের নাম, বৈশিষ্ট্য। বলত, আমি অমুক লোকের জন্য উপকারী, প্রাণবর্ধক। অমুক স্বভাবের লোকদের জন্য অপকারী, প্রাণঘাতক। সুলায়মান (আ.) সেসব কথা সে যুগের চিকিৎসকদের কাছে বলতেন। তারা লিখে নিতেন আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের গুরুর মর্যাদা পেতেন।
মওলানা রুমি বলেন, জগতের বুকে যত জ্ঞান তার উৎস আল্লাহর ওহি। সেখান থেকেই জ্ঞানের ফল্গুধারা উৎসারিত হয়। তারপর মানুষের নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধি যুক্ত হয়ে তা বিকশিত পল্লবিত হয়।
ইন নুজুম ও তিব্ব ওয়াহয়ে আম্বিয়া’স্ত
আকল ও হিস রা’ সূয়ে বী সূ রাহ কুজা’স্ত
জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র এসেছে নবীদের ওহির সূত্রে
প্রজ্ঞা ও ইন্দ্রিয় কি অতি প্রাকৃতিক জগতের পথ খুঁজে পাবে।
মানুষের যে আকল, বুদ্ধি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা তা আংশিক, খ-িত। এ খ-িত আকলের কি শক্তি আছে, অতিন্দ্রিয় জগৎ, আকল সমগ্র, যার সীমা নেই, স্থান নেই, সেই জগৎ থেকে জ্ঞানের সওগাত নিয়ে আসবে। বরং জ্ঞান প্রথমে আসে আকল সমগ্র বা অতি প্রাকৃতিক জগতের জ্ঞান ভা-ার থেকে। সেই জ্ঞানকে মানুষের আংশিক জ্ঞানবুদ্ধি বিশ্লেষণ করে, সংযোজন-বিয়োজন করে। এর নাম দেওয়া হয় আবিষ্কার, উদ্ভাবন, নতুন সৃষ্টি। অতিন্দ্রিয় জগতের সেই জ্ঞান লাভ করতে হয়, সেই গুণবৈশিষ্ট্যের শিক্ষকের কাছ থেকে। তারা আল্লাহর নবী ও রাসুল। মওলানা রুমি যুক্তি দিয়ে বলেন, দেখ, পৃথিবীতে এমন কোনো জ্ঞান কি আছে, যা ওস্তাদ ছাড়া শেখা যায়?
বস্তুত মানুষ যে জ্ঞান আয়ত্ত করে, আবিষ্কার করে, তা অতিপ্রাকৃতিক জগৎ থেকেই উৎসারিত। এ উৎসারণের নাম ওহি। সাধারণ অর্থে আমরা বুঝি, ফেরেশতা মারফত নবী-রাসুলদের কাছে নাজিলকৃত আসমানি প্রত্যাদেশ ওহি। এর বাইরে প্রকৃতিক জগতে প্রাণী ও বস্তুনিচয়ের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা আসে তা-ও কোরআনের ভাষায় ওহি। যেমনÑ মৌমাছিরা মধু সংগ্রহের জন্য প্রাকৃতিকভাবে যে নির্দেশনা পায় কোরআনে তাকে বলা হয়েছে ‘আউহা’, যার মূল ধাতু ওহি। অবশ্য বাংলায় ‘অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ’ বাক্য দিয়ে এর তরজমা করা হয়।
‘তোমার প্রতিপালক মৌমাছিকে তার অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন, গৃহ নির্মাণ করো পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে।’ (সূরা নাহাল : ৬৮)।
নবী-রাসুলদের প্রতি প্রেরিত ওহিতে ভুলের অবকাশ নেই। অন্যদের প্রতি প্রদত্ত অনুক্ত নির্দেশনায় ভুলের অবকাশ থাকে। পরিভাষায় এ নির্দেশনার নাম ইলহাম। ধারকের যোগ্যতা বা বোঝার তারতম্যের কারণে ইলহামে ভুলের আশঙ্কা থাকে। কোরআনে বর্ণিত আরেকটি ঘটনায় কাক আল্লাহর এমন নির্দেশ লাভ করে এবং মানবসমাজে জ্ঞান বিতরণের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।
পৃথিবীতে মানবজাতির আবির্ভাবের সূচনায় একমাত্র দম্পতি ছিলেন আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)। তাদের ঘরে সন্তান জন্ম নিত জোড়ায় জোড়ায়, এক মেয়ে এক ছেলে যমজরূপে। শরিয়তের বিধান ছিল এক জোড়ার ছেলে অন্য জোড়ার মেয়ের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। ঘটনাক্রমে কাবিলের জোড়ার মেয়েটি ছিল সুন্দরী আর হাবিলের জোড়ার মেয়েটি অসুন্দরী। কাবিল শরিয়তের বিধান লঙ্ঘন করে বলল, আমি আমার জোড়ার বোনকেই বিয়ে করব, হাবিলকে বিয়ে করতে দেব না। কাবিল তার পথের কাঁটা সরানোর জন্য হাবিলকে হত্যা করল। হত্যার পর রক্তমাখা লাশ নিয়ে বিপদ দেখা দিল। এ লাশ কোথায় লুকাবে? লাশ কাঁধে নিয়ে তখন সে উ™£ান্ত ঘুরতে লাগল। এ সময় দুটি কাক কাবিলের সামনে এসে ঝগড়ায় লেগে গেল। এক পর্যায়ে একটি কাক অপরটিকে মেরে ফেলল। এরপর জীবিত কাকটি ঠোঁট আর পায়ের নখ দিয়ে মাটি খনন করে মরা কাকটিকে মাটিচাপা দিল। এ দৃশ্য দেখে কাবিল তার ভাইয়ের লাশ মাটিতে দাফন করার জ্ঞান লাভ করল।
দফন কর্দশ পস বেপূশীদাশ বে খা’ক
যা’গ আয এলহা’মে হক বুদ এলম না’ক
তাকে দাফন করে চাপা দিল মাটির নিচে
কাক সমৃদ্ধ হয়েছিল আল্লাহর ইলহামের গুণে।
এরশাদ হয়েছেÑ ‘অতঃপর আল্লাহ এক কাক পাঠালেন, যে (কাক) তার (কাবিলের) ভাইয়ের লাশ কীভাবে গোপন করা যায়, তা দেখানোর জন্য মাটি খনন করতে লাগল। সে তখন বলল, হায়! আমি কি এ কাকের মতো হতে পারলাম না, যাতে আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি। অতঃপর সে অনুতপ্ত হলো।’ (সূরা মায়েদা : ৩১)।
মওলানা বলেন, আসমানি সাহায্য ও নির্দেশনা ছাড়া লাশ দাফন করার অতি সাধারণজ্ঞানও মানুষ নিজের বুদ্ধির বলে আয়ত্ত করতে পারেনি। কাজেই মানুষের আকল বা প্রজ্ঞাকে যুক্ত হতে হবে সেই প্রজ্ঞাসমগ্রের সঙ্গে, যা জগতের সব প্রজ্ঞার উৎস। প্রজ্ঞাসমগ্রের সঙ্গে যুক্ত না হলে মানুষের আংশিক বা খ-িত প্রজ্ঞা কিছুতেই সঠিক পথের সন্ধান পাবে না। প্রজ্ঞাসমগ্রমুখী এ আকল বা প্রজ্ঞাকে মেরাজের ঘটনায় ‘মা যাগাল বাসারু ওয়ামা তাগা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ঐশী প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে ঊর্ধ্বলোকে নবীজির দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, তাঁর দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। (সূরা নজম : ১৭)। মওলানা রুমি বলেন, আল্লাহর খাস বান্দারা এমনই প্রজ্ঞার অধিকারী হয়ে থাকেন। যার অপর নাম নুর। এ নুর লাভের জন্য দোয়া করতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে হাদিস। মওলানা বলেনÑ
আকলে মা’ যা’গ আস্ত নূরে খাসসেগা’ন
আকলে যাগ উস্তা’দে গূরে মুর্দেগা’ন
বিভ্রমহীন প্রজ্ঞা সে তো খাস বান্দাদের নুর
কাকের প্রজ্ঞা মৃতদের গুরু, তার গন্তব্য গোর।
আল্লাহর খাস বান্দাদের হৃদয়ের জ্যোতি ঊর্ধ্বলোকের পথ দেখায়। যাদের জ্ঞান ঊর্ধ্বলোকের অভিসারী নয়, তারা দুনিয়ার কাকের মতো ময়লা-আবর্জনায় ভাগাড়ে পড়ে থাকে। দুনিয়ার কাক তাদের জন্য কবরের দিশারি। বড়োজোর কবরস্থানের পথ দেখায়, বাগানের পথে নিয়ে যায় না। কাজেই তুমি যদি জীবনে সিদ্ধি লাভ করতে চাও, সাধনায় সফল হতে চাও তাহলে দিলের মসজিদুল আকসার চত্বরে বিচরণ কর। তোমার দিলে চারাগাছের মতো নানা ভাবনার উদয় হয়, সেগুলোর হাকিকত পরখ কর। সুলায়মান (আ.) এর মতো সত্য-তথ্যের সন্ধানী হও। কোনটি উপকারী, কোনটি অপকারী প্রাণঘাতী, নির্ণয় কর।
তো সুলায়মানওয়া’র দা’দে উ বেদেহ
পেই বর আয ওয়াই পা’য়ে রদ বর ওয়াই মনেহ
সুলায়মানের মতো কর তুমি তার যথার্থ হক প্রদান
তার মর্ম কি উপলব্ধি কর, করো না প্রত্যাখ্যান।
মওলানা রুমি আমাদের অনেক গভীরে নিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনার পথ বাতলে দিচ্ছেন। সুলায়মান (্আ.) এর সামনে মসজিদুল আকসা চত্বরে যেমন উদ্ভিদ উদ্গত হচ্ছিল আর তিনি ওগুলোর গুণাগুণ জিজ্ঞেস করে হেকিমদের বলে দিচ্ছিলেন, তুমিও খেয়াল করলে দেখতে পাবে, তোমার দিলের মসজিদুল আকসা চত্বরে নানা উদ্ভিদ জন্মাচ্ছে। নানা ধরনের চিন্তাভাবনার আনাগোনা চলছে। এগুলোই মনের জমিনের উদ্ভিদ। এর মধ্যে কোনটা উপকারী, কোনটা ক্ষতিকর, তা পরখ করতে হবে।
মনের এসব চিন্তাভাবনাকে বলা হয় ‘খাওয়াতের’। খাওয়াতের চার প্রকার। নফসানি, শয়তানি, মলকি, রহমানি। কুপ্রবৃত্তির ভাবনা থেকে উদ্গত ভাবনা নফসানি। শয়তানের প্ররোচনায় উদিত মনের ভাবনা শয়তানি। ফেরেশতার সংস্পর্শে সৃষ্ট ভালো ভাবনার নাম মলকি আর স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে উদ্ভাসিত ভাবনাকে বলা হয় রহমানি। আধ্যাত্মিক সিদ্ধিলাভ করতে হলে এগুলো চিনতে হবে। অন্তরের জমিন থেকে নফসানি, শয়তানি ভাবনার আগাছার জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হবে। নফসানি, শয়তানি ভাবনা অনেক সময় রহমানি ভাবনার রূপ ধারণ করে। এর ফারাক তোমাকে বুঝতে হবে। এমনকি মলকি বা ফেরেশতাসুলভ ভাবনার প্রাবল্যে তুমি প্রতারিত হয়ে মনের অজান্তেই পথ হারাতে পার।
বিষয়টির প্রতি মনোযোগী হলে তোমার একটি নগদ লাভ আছে। উদ্ভিদ বা ফলফসল দিয়েই জমি চেনা যায়। তোমার দিলের জমিনে উদ্গত ফসল ও উদ্ভিদরূপী এসব ভাবনা নিরীক্ষণ করেই তুমি নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। বুঝতে পারবে তোমার জমিটা কেমন। মনের দিক থেকে তুমি কী প্রকৃত মানুষ, নাকি নফসের দাস, শয়তানের দোসর। তোমার মনের ভাবনা যদি মন্দের দিকে যায়, তাহলে তুমি মন্দ আর যদি ভালোর দিকে যায়, তাহলে তুমি ভালো। কারণ তোমার মনোজগতে যা বিরাজ করে সেটিই তুমি। বাইরের লেবাস, নামধাম, পদ-সম্পদ খোলসমাত্র।