শিশুদের যেভাবে গড়ে তুলবেন
শিশু একটি সাদা কাগজস্বরূপ। তাতে মা-বাবা ও চারপাশের পরিবেশ চিত্র অঙ্কন করে। তার ভেতর তা-ই খোদাই হয়ে যায় এবং সে চিত্র খুবই স্পষ্ট ও স্থিতিশীল হয়। সে জন্য চেষ্টা করা উচিত যাতে শিশুর মন-মেধায় কোনো ভুল বিষয় গেঁথে না যায়। তার কর্মজীবনে কোনো বক্র স্বভাব সৃষ্টি না হয়। শিশু সন্তানের বিকৃত বা মন্দ স্বভাব দেখা দিলে তার প্রকৃত ‘কারণ’ অনুসন্ধান করে প্রতিবিধানের চেষ্টা করা চাই। অন্যথায় শিশুকে সংশোধনের ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যাবে। তাই শিশু সন্তান নষ্টের কারণ এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা আবশ্যক মনে করে নিচে তা তুলে ধরা হলো।
মা-বাবা কিংবা ঘরের লোকদের পারস্পরিক তিক্ত মনোভাব ও ঝগড়া-বিবাদ শিশুকে নষ্ট করে। তাদের এ তিক্ত স্বভাব এবং অস্বাভাবিক কথাবার্তায় শিশুকে চারিত্রিক ও মানসিকভাবে রোগাক্রান্ত করে। স্বামী-স্ত্রীর আন্তরিক ও সুখকর সম্পর্ক না থাকলে শিশু নষ্ট হওয়া সুনিশ্চিত। এহেন অবস্থায় সংসারের সংশোধন একান্ত জরুরি।
শিশুদেরে সামনে পরিবারের সদস্যদের ভুল নমুনা বা দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে তাকে নষ্টের দিকে নিয়ে যায়। সে যখন বড়দের ভুল বা অসামাজিক কাজ করতে দেখে, তখন সে কাজগুলো করতে শিশুটি মোটেও কুণ্ঠাবোধ করে না। শিশুদের চারিত্রিক মনোভাব সংশোধনে বড়জনের ভুল কর্ম, ভুল নমুনা যেন প্রকাশিত না হয় সে দিকে সদস্যদের সবার লক্ষ্য রাখা উচিত।
অসৎসঙ্গ শিশুদের অবশ্যই নষ্ট করে দেয়। বিচক্ষণ, ভদ্র-সম্ভ্রান্ত মা-বাবার সন্তানও কুসঙ্গের কারণে নষ্ট হয়। তবে অসৎসঙ্গ এড়াতে শিশুদের নির্জনতা ও একাকিত্ব জীবনে উৎসাহিত করা ঠিক নয়। যার কারণে শিশুদের বিভিন্ন চারিত্রিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত করে। এ জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য সৎ সঙ্গীদের সঙ্গ জরুরি।
শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শারীরিক গঠনাকৃতির বিকাশ-বৃদ্ধিও হতে থাকে। তার সঙ্গে মিল রেখে শিশুদের স্বাস্থ্যসম্মত কাজকর্ম ও চিত্তাকর্ষক ব্যস্ততার প্রয়োজন হয়। এতমাবস্থায় আপন সন্তানের জন্য বয়স ও যোগ্যতা অনুযায়ী হৃদয়গ্রাহী ও গঠনমূলক কাজকর্মের ব্যবস্থা করতে হবে। যার কারণে বিভিন্ন বদভ্যাস বা কু-অভ্যাস থেকে তারা বেঁচে যায়।
শিশুদের মধ্যে নিজে নিজে অভিজ্ঞতা অর্জন করার আকর্ষণ জন্মগতভাবে বিদ্যমান। ওই অভিজ্ঞতা অর্জনের সময় যদি তাদের দ্বারা কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, তবে তাদের প্রতি বিরক্ত বা অতিষ্ঠ না হয়ে হাসিমুখে তা সহ্য করা উচিত। তাতে শিশুদের মনে অবশ্য কর্মণ্যতা জাগবে।
শিশুর প্রাকৃতিক চাহিদা, স্বভাবগত দাবি ও আকাক্সক্ষাগুলো যদি বৈধভাবে পূর্ণ করা না হয়, তাহলে শিশুরা নিজেই সেই আকাক্সক্ষাগুলো ভুল পথে বা ভ্রান্ত পন্থায় পূর্ণ করার প্রবল আশঙ্কা থাকে। কাজেই শিশুদের স্বভাবগত চাহিদা ও আকাক্সক্ষা পূর্ণ করার পুরোপুরি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কিন্তু অস্বাভাবিক আদর-প্রীতি দিয়ে সন্তানকে মাথায় ওঠানো যাবে না। কারণ, অতি আদরও শিশুকে নষ্ট করে ফেলে। এ ক্ষেত্রে মিতাচার ও ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যধিক প্রয়োজন।
বর্তমান সমাজে দেখা যায় কোনো কোনো শিশু মা-বাবার ন্যায্য স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হয়। অবশেষে তা তাদের মধ্যে বহু ধরনের মানসিক ও চারিত্রিক রোগব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই আপন সন্তানের সঙ্গে নিঃশর্ত ভালোবাসা বজায় রাখা মা-বাবার দায়িত্ব।
শিশু যদি মা-বাবার দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা কোনো শারীরিক দুর্বলতার দরুন হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে নষ্ট হতে শুরু করে, তা হলে তাৎক্ষণিক চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধন করা মা-বাবার অবশ্য কর্তব্য। কথায় কথায় রেগে যাওয়া বা শাসানো কিংবা ধমকানো প্রদর্শনে শিশুদের মধ্যে হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করে। যার কারণে অনেক ত্রুটি ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
ঘরে যদি যথোপযুক্ত উঁচু ধ্যান-ধারণা বিদ্যমান না থাকে বরং হীন-নীচ ধ্যানধারণা বিদ্যমান থাকে, তা হলে শিশুদের থেকে মহৎ কর্মের আশা রাখা, উচ্চ ভূমিকা পালন করা, অনন্য কৃতিত্ব স্থাপনের প্রত্যাশা মূলত যব গাছ রোপণ করে জাম পাওয়ার আশা পোষণের নামান্তর। কাজেই উত্তম কর্মসম্পাদন, উন্নত চরিত্র গঠনের জন্য ঘরে উঁচু ধ্যান-ধারণা ও উন্নত চিন্তাধারা থাকা জরুরি।
বর্তমানে শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থাও শিশু নষ্টের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, শিক্ষাঙ্গনে বিশৃঙ্খল-কলুষিত পরিবেশ, ছাত্র-শিক্ষকদের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপড়েন এবং অযাচিত অবস্থায় শিক্ষাঙ্গন যেন সন্তান নষ্ট হওয়ার আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তাই আপন সন্তানের জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা উচিত। যেখানে উল্লেখিত ত্রুটিগুলো অপেক্ষাকৃত কম থাকবে।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ হওয়ায় শিশুকে লাগামহীন ছেড়ে দেওয়া নিতান্তই দুঃখজনক ব্যাপার। সে জন্যই পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র উন্নয়নে শিশুকে সুন্দর চরিত্র গঠনে মা-বাবা ও অভিভাবককে কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে। আর শিশুর জন্য সুন্দর ও সুশৃঙ্খল পরিবেশে গঠন করলেই সমাজে কিছুটা হয়তো শান্তি বয়ে আনবে।