যিনি ধনীদের মধ্যে সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন
জর্দানের রাজধানী আম্মানের উত্তরের শহর জুবাইহা এলাকায় অবস্থিত এ স্থাপনাটিকে অনেকেই এ মহান সাহাবির কবর মনে করেন। আসলে তার কবর মদিনার বাকি কবরস্থানে। সাহাবি আবদুর রহমান (রা.) শামে যাওয়ার সময় এখানে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। বস্তুত ওই স্মৃতি রক্ষার্থেই এ স্থাপনা। (সূত্র ইউকিপিডিয়া আরবি)।
ইসলামের প্রথম দিকে আবুবকর সিদ্দিক (রা.) এর দাওয়াতে যারা মুসলমান হয়েছেন আবদুর রহমান বিন আউফ তাদের অন্যতম। তিনি ৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে কোরাইশের বনু জোহরা গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। বয়সে তিনি নবীজি (সা.) থেকে ১০ বছরের ছোট। ইসলাম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল আবদে আমর বা আবদুল কাবা। নবীজি নাম পরিবর্তন করে রাখেন আবদুর রহমান।
মক্কার কাফেরদের অবর্ণনীয় জুলুম-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি হাবশায় প্রথমবার হিজরত করেন। পরবর্তী সময়ে মদিনায় স্থায়ীভাবে হিজরত করেন। মদিনা হিজরতের পর নবীজি (সা.) তাকে সাদ ইবনে রবি আনসারির সঙ্গে ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপন করে দেন। সাদ (রা.) তাকে ডেকে বললেন, ‘আনসারদের সবাই জানে, আমি একজন ধনী ব্যক্তি। আমি আমার সব সম্পদ সমান দুইভাগ করে আপনাকে একভাগ দিতে চাই। আর আমার দুইজন স্ত্রী আছে। তাদের যাকে আপনার পছন্দ হয় আমি তাকে তালাক দেব। তারপর আপনি তাকে বিবাহ করে নেবেন।’ আবদুর রহমান (রা.) বললেন, আল্লাহ আপনার পরিবার ও সম্পদে বরকত দান করুন। ভাই, আমার এসব কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। আমাকে শুধু বাজারের পথটি দেখিয়ে দিন।’
ইসলামি ভ্রাতৃত্বে সাদ ইবনে রবির এ অতুলনীয় উদারতা মানব জাতির ইতিহাসে বিরল। অপরদিকে আবদুর রহমান বিন আউফের আত্মনির্ভরতা ও নিজ পায়ে দাঁড়ানোর দৃঢ়তার বিষয়টিও লক্ষণীয়। তিনি মদিনার কাইনুকা বাজারে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যবসা শুরু করেন। কিছু পয়সা হাতে জমা হলে এক আনসারি মহিলাকে বিবাহ করেন। নবীজি (সা.) তার কাপড়ে হলুদের দাগ দেখে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি বিবাহ করেছ? বললেন, হ্যাঁ। নবীজি বললেন, ‘একটি ছাগল দিয়ে হলেও ওলিমা করে নাও।’ তিনি ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকলেন। কিছুদিন পর আরও কিছু পয়সা জমা হলে নবীজির নির্দেশ মতো ওলিমার কাজটি সেরে নেন। (বোখারি : ২০৪৯)।
আল্লাহর পথে দানের অনন্য ব্যক্তিত্ব আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) সম্পূর্ণ রিক্ত হস্তে মদিনায় এসেছিলেন। সামান্য ঘি ও পনির বেচাকেনার মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন। কালক্রমে তিনি একজন সেরা ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সম্পদ বৃদ্ধির জন্য দোয়া করেছেন এবং আল্লাহ তা কবুলও করেছেন। কিন্তু সম্পদের প্রতি লোভ ও আকর্ষণ তার মধ্যে ছিল না। আল্লাহর রাস্তায় এবং মানবকল্যাণে অকৃপণ হাতে সম্পদ ব্যয় করতেই তিনি আনন্দ পেতেন। তার অত্যধিক দানের কারণে এ কথা বলা হতো, আবদুর রহমানের সম্পদের মধ্যে মদিনাবাসীর অংশ রয়েছে। একবার রাসুল (সা.) ঘোষণা দিলেন, ‘আমি একটি অভিযানে সৈন্য পাঠানোর ইচ্ছা করেছি, তোমরা সাহায্য কর।’
আবদুর রহমান বিন আউফ দৌড়ে বাড়ি গেলেন। ফিরে এসে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার কাছে এ চার হাজার আছে। দুই হাজার আমার রবকে করজে হাসানা দিলাম। আর বাকি দুই হাজার আমার পরিবারের জন্য রেখে দিলাম। রাসুল বললেন, ‘তুমি যা দান করেছ এবং যা রেখে দিয়েছ তার সবকিছুতেই আল্লাহ বরকত দান করুন।’ তাবুক যুদ্ধের সময় তিনি রেকর্ড পরিমাণ সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করেন। তা দেখে ওমর (রা.) বলে ফেললেন, আমার মনে হচ্ছে আবদুর রহমান পরিবারের জন্য কিছুই রাখেননি। রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, পরিবারের জন্য কিছু রেখেছ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসুল বললেন, কত? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যে রিজিক ও প্রতিদানের অঙ্গীকার করেছেন তাই।’
একবার সিরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নিয়ে তার একটি বাণিজ্য কাফেলা মদিনায় এলো। ৫০০ মতান্তরে ৭০০ উটের পিঠে মালপত্র বোঝাই ছিল। এতে মদিনায় রব পড়ে গেল। উম্মুল মোমিনিন আয়শা (রা.) বললেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, আবদুর রহমান জান্নাতে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করবে।’ উম্মুল মোমিনের এ কথা আবদুর রহমানের কানে গেল। তিনি বললেন, ‘হে জননী! আমি এ বিশাল বাণিজ্য সম্ভার আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিলাম।’ (উসদুল গাবাহ)।
আনাস (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘আমার উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম (ধনী হিসেবে) জান্নাতে প্রবেশ করবে আবদুর রহমান বিন আউফ। তিনি হামাগুড়ি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন।’ (মুসনাদে বাজ্জার : ৭০০৩)।
ইবনে হাজার (রহ.) আল-ইসাবা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) মোট ৩০ হাজার দাস মুক্ত করেছেন। তিনি আল্লাহর রাস্তায় ৪০ হাজার দিনার, ৫০০ ঘোড়া এবং ৫০০ বাহন দান করেছেন। (উসদুল গাবাহ)।
অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েও তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও দুনিয়াবিমুখ। সম্পদের ব্যাপারে সবসময় ভয়ে থাকতেন। সাদ ইবনে ইবরাহিম তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, একদিন আবদুর রহমান বিন আউফ সিয়াম পালন করছিলেন। ইফতারের সময় তার সামনে উত্তম খাবার পরিবেশ করা হলো। এ খাবারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মুসয়াব ইবনে উমায়ের ছিলেন আমার থেকে উত্তম মানুষ। তিনি শহীদ হলে তার জন্য মাত্র ছোট্ট একখানা কাফনের কাপড় পাওয়া গিয়েছিল। তা দিয়ে মাথা ঢাকলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বের হয়ে যেত। এখন আল্লাহ আমাদের জন্য দুনিয়ার প্রাচুর্য দান করেছেন।
আমার ভয় হয়, না জানি আমাদের বদলা দুনিয়াতেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ অতঃপর তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন এবং খাবার গ্রহণ করেননি। (উসদুল গাবাহ)। আরেকবার তার সামনে গোশত ও রুটি পেশ করা হলে তিনি কাঁদতে শুরু করেন। অতঃপর বলেন, ‘প্রিয়তম রাসুল (সা.) এমতাবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন যে, তিনি এবং তাঁর পরিবার যবের রুটি পেটপুরে খেতে পারেননি। জানি না, আমাদের উত্তম জিনিস থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কিনা।’ (ইতহাফ : ৭৩৪২)।
আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) এর অত্যন্ত প্রিয় সাহাবি। তিনি নবীজির সঙ্গে সব যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেছেন এবং অত্যন্ত সাহস ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন। ইমাম বোখারি (রা.) ‘কিতাবুল মাগাজিতে’ তার সনদে বদর যুদ্ধের একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখ করেছেনÑ আবদুর রহমান বিন আউফ (রা.) বলেন, বদর যুদ্ধে আমি সারিতে দাঁড়িয়ে। তুমুল লড়াই চলছে। আমি ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে আমার দুই পাশে দুই বালক নওজোয়ানকে দেখলাম।
তাদের প্রতি আমার খুব একটা আস্থা হলো না। তাদের একজন ফিসফিস করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, চাচা! আবু জাহেল কোন দিকে? আমি বললাম, ভাতিজা! তাকে দিয়ে তুমি কী করবে? সে বলল, আমি আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করেছি, হয় আমি তাকে কতল করব না হয় এ উদ্দেশ্যে আমার জীবন কোরবান করব। একই কথা বলল অন্যজনও। তাদের কথা শোনার পর আমার আনন্দ হলো এই ভেবে, কত মহান দুই ব্যক্তির মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে! আমি ইশারা করে আবু জাহেলকে দেখিয়ে দিলাম। অমনি তারা একসঙ্গে বাজপাখির মতো আবুজাহেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই তাকে কতল করে ফেলল। এ দুই নওজোয়ান ছিল আফরার দুই পুত্র মোয়াজ ও মোয়াওবিজ।
বদরের যুদ্ধে আবদুর রহমান (রা.) পায়ে আঘাত পান। ওহুদ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করে অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন। আল্লামা ইবনে খালদুন তার তারিখে বর্ণনা করেছেনÑ এ যুদ্ধে তিনি সারাদেহে মোট ৩১টি আঘাত পান। ষষ্ঠ হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা থেকে ৩০০ মাইল উত্তরে ‘দাউমাতুল জান্দালে’ একটি জিহাদি অভিযান প্রেরণ করেন। এ অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব দেন আবদুর রহমান ইবনে আউফকে। যাত্রার আগে রাসুল (সা.) নিজ হাতে আবদুর রহমানের মাথার পাগড়িটা খুলে অন্য আরেকটি কালো পাগড়ি বেঁধে দেন। তারপর যুদ্ধের কৌশল সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনা দিয়ে বিদায় জানান।
নবম হিজরিতে তিনি রাসুল (সা.) এর সঙ্গে তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এ অভিযানকালে একদিন রাসুল (সা.) প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে যান। ফিরতে একটু দেরি হয়। এদিকে নামাজের সময়ও হয়ে যায়। সমবেত মুসল্লিদের অনুরোধে আবদুর রহমান (রা.) ইমাম হিসেবে নামাজে দাঁড়িয়ে যান। রাসুল (সা.) ফিরে এসে দেখেন এক রাকাত হয়ে গেছে। তিনি আবদুর রহমানের পেছনে ইকতেদা করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর উপস্থিতি অনুভব করে আবদুর রহমান (রা.) পেছনে সরে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাসুল (সা.) তাকে নিজের স্থানে থাকার জন্য ইশারা করেন। অতঃপর তিনি দ্বিতীয় রাকাতটিও শেষ করেন। নামাজ শেষে নবীজি বললেন, ‘তোমরা সঠিক কাজ করেছ।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
রাসুল (সা.) এর জীবদ্দশায় শুধু দুইজন সাহাবি তাঁর ইমামতি করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তারা হলেন আবুবকর সিদ্দিক ও আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)।
৩১ মতান্তরে ৩২ হিজরিতে মদিনায় তার মৃত্যু ঘটে। তখন তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তাকে বাকি কবরস্থানে দাফন করা হয়। ওসমান বিন আফফান (রা.) তার জানাজা পড়ান। মারা যাওয়ার তিনি এর অসিয়ত করে গিয়েছিলেন।