আল্লাহর অন্যতম নেয়ামত মাছ
প্রকৃতিজুড়ে এখন চলছে হেমন্তের রাজত্ব। নতুন ধানের নবান্ন উৎসবের পাশাপাশি অন্য আরেকটি উৎসবে মেতে উঠেছে গ্রামের মানুষ। তা হলো মাছ ধরার উৎসব। বর্ষায় ডুবে যাওয়া খাল-বিল, নদী-নালার পানি অনেকটা কমে আসায় সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে ছোট-বড় অনেক মাছ। বোয়াল, শোল, মাগুর, টেংরা, পুঁটি, চিংড়ি, খলশে, কৈ আরও কত কী! সকালের কুয়াশা উপেক্ষা করে গ্রামের মানুষ নেমে পড়েন বিলের ঠান্ডা পানিতে। সঙ্গে থাকে মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম আর ফাঁদ। মহাআনন্দ নিয়ে সবাই একসঙ্গে ডেকচি ভরে ধরেন অনেক মাছ। এ যেন হেমন্তকালীন অন্য আরেকটি উৎসব। ছোট-বড়, ছেলে-মেয়ে সবাই মেতে ওঠেন এ উৎসবে। গ্রামগঞ্জে এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের প্রায়ই দেখা মেলে। মাছ যেন আমাদের রক্তে-মাংসে মিশে আছে। মিশে আছে আমাদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্বে। সে জন্যই আমাদের পরিচয়, আমরা ‘মাছে-ভাতে বাঙালি।’
মাছ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি এসিড, যা মানুষের মস্তিষ্ক, চোখ ও স্নায়ুতন্ত্র গঠনে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রায় ৬০ শতাংশ প্রাণিজ আমিষের জোগান দেয় এ মাছ। এ ছাড়াও মাছের চামড়া, হাড়, কাঁটা, চর্বি ইত্যাদি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া শুশুক, হাঙর প্রভৃতির তেল দ্বারা নানা ধরনের ওষুধ, বার্নিশ, গ্লিসারিন, সাবান ইত্যাদি তৈরি করা হয়ে থাকে। সুস্থ-সবল ও মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে মাছের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহান আল্লাহ আমাদের জন্য এ অনন্য নেয়ামত তথা মাছের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘তিনিই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রকে। যাতে তা থেকে তোমরা তাজা গোশত (মাছ) খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার পরিধেয় অলংকার…।’ (সূরা নাহল : ১৪)।
সমুদ্রের তলদেশে হাজারো প্রাণীর বসবাস রয়েছে। এর মধ্যে মাছ প্রধান অবস্থানে রয়েছে। প্রতিদিন প্রচুর মাছ ধরা হয় সমুদ্র থেকে। এসব মাছ খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি পরিবেশবান্ধবও। কারণ এ মাছগুলো সমুদ্রের পানির বিষাক্ত পদার্থ ফিল্টার করে। এ ছাড়া নদীমাতৃক এ দেশের হাওর-বাঁওড়, বিল, খাল, ডোবা, পুকুর, নদী, উপনদী ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়। এদেশে মাছের আধিক্যের কারণে দরিদ্র পরিবারগুলোতে আমিষের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। আকার-আকৃতিতে মাছগুলো যেমন বিচিত্র, তেমনি নামগুলোও বেশ মজার। যেমন, বৌ মাছ, গুলশা, তপসে, চিতল, কাকিলা, কই, শিং, পাবদা ইত্যাদি।
আমাদের দেশে দুই ধরনের মাছ পাওয়া যায়। ১. স্বাদু বা মিঠা পানির মাছ ও ২. লোনা পানির মাছ। মিঠা বা স্বাদু পানির মাছের মধ্যে রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, আইড়, বোয়াল, পাঙ্গাশ, কালিবাউশ, শোল, গজার, কই, মাগুর, মলা, চিংড়ি, পাবদা, তেলাপিয়া ইত্যাদি। আর লোনা পানির মাছ বলা হয় সামুদ্রিক মাছকে। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ইলিশ প্রধান। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। এছাড়াও রয়েছে লাক্ষা, রূপচাঁদা, চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, হাঙর, পোয়া, ভেটকি, কোরাল, বোয়াল ইত্যাদি। পানির দু-ধারার কথা উল্লেখ করে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আর সমুদ্রের দুটি পানির ধারা সমান নয়। একটি তো মিঠা পানি পিপাসা নিবারণকারী।
এর পানি সুস্বাদু। আর অপর ধারা তীব্র লবণাক্ত ও বিস্বাদ। কিন্তু এ উভয় ধারা থেকেই তোমরা টাটকা তাজা গোশত (মাছ) লাভ করে থাক এবং আহরণ করো মণি-মুক্তার অলংকারের জিনিস যা তোমরা পরিধান করো। আর এ পানিতেই তোমরা দেখছ নৌকাগুলো তার বুক চিরে চলাচল করছে যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ তালাশ করো এবং যাতে তোমরা শোকর আদায়কারী হও।’ (সূরা ফাতির : ১২)।
আমাদের দেশে প্রাপ্ত মাছের মধ্যে বেশিরভাগ মাছই খাদ্যোপযোগী এবং হালাল। হাদিসে এসেছে, ‘এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমরা সমুদ্রে ভ্রমণ করি। আমাদের সঙ্গে সামান্য পানি থাকে, তা দিয়ে যদি আমরা অজু করি, তাহলে সমুদ্র থেকে (এর পানি দিয়ে) কি অজু করব?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এর পানি পবিত্র এবং এর মৃত (মাছ) হালাল।’ (তিরমিজি : ৬৯)।
হজরত আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি হজরত জাবির (রা.) কে বলতে শুনেছেন, ‘আমরা জাইশুল-খাবতের যুদ্ধে ছিলাম। আমদের সেনাপতি ছিলেন আবু উবায়ইদা (রা.)। আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লাম। সমুদ্র একটি তিমি জাতীয় মাছ (তীরে) নিক্ষেপ করল। এ ধরনের মাছ আমরা (এর আগে) দেখিনি। এ জাতীয় তিমিকে আম্বর বলা হয়। আমরা ১৫ দিন ধরে মাছটি খেলাম। এরপর আমরা মদিনায় ফিরে নবী করিম (সা.) এর কাছে এ কথা বললাম।’ তিনি বললেন, ‘আহার করো, রিজিক, এটা আল্লাহ পাঠিয়েছেন। (আর) তোমাদের সঙ্গে যদি এর কিছু (অংশ) থাকে তা হলে আমাদেরও এর স্বাদ গ্রহণ করতে দাও। তাদের কেউ তার কিছুটা এনে দিলে তিনি তা খেলেন।’ (বোখারি : ৪০১৬)।
তবে চিংড়ি মাছের বেলায় ফোকাহায়ে কেরামের মাঝে বৈধ ও মাকরুহ হওয়ার ব্যাপারে কিছু মতানৈক্য থাকলেও অধিকাংশ হানাফি মাজহাবের মুহাক্কিক ফোকাহায়ে কেরামের মতে, চিংড়ি মাছ শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে মাছের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। তাই চিংড়ি মাছ খাওয়া হালাল। অবৈধ বা মাকরুহ নয় এবং এ মতই বিশুদ্ধ। (হেদায়া, কুদুরি ও হায়াতুল হায়ওয়ান দ্বিতীয় খ-)।
এসব মাছ যেমন আমাদের পুষ্টিসাধন করছে, তেমনি বিদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করছে। দেশের রফতানি আয়ের ২ শতাংশের অধিক আসে এ মৎস্য খাত থেকেই। শুধু তাই নয়, মৎস্য সম্পদ বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৫ শতাংশ। আর আমাদের বার্ষিক মৎস্যের উৎপাদন হলো ১৫ লাখ ২৪ হাজার টন। মাছ আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতি ও উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সহায়তা করছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ফলে মাছ চাষ করে মানুষ দিন দিন যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে, তেমনি মাছ ও মাছের পোনা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করার জন্য পরিবহন ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন হচ্ছে।
কিন্তু বাংলাদেশের সব কলকারখানা ও বাড়িঘরের ড্রেন নদী-নালার সঙ্গে সংযুক্ত। এসব কারখানার ময়লা-আবর্জনা পড়ছে গিয়ে নদীতে। ফলে নদীর পানি ময়লা ও গন্ধযুক্ত হয়ে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে নদী-নালার মাছ। ঠিকমতো বংশবিস্তারও হচ্ছে না তাদের। এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।
শিক্ষক : জামিয়া ইসলামিয়া এমদাদুল উলুম বাগ্নিবাড়ি মাদ্রাসা, সাভার, ঢাকা