দেড় যুগ পর বিসিএসে ঝিনাইদহের আশরাফ
আশাবাদী মানুষটির নাম মো. আশরাফুল ইসলাম (দিপু)। পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে। ১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৯৯ সালে। তবে কেন আশরাফ আশাবাদী? সেই গল্পটি আগে জানা দরকার। এজন্য ফিরতে হবে ১৭ বছর পেছনে, ২০০২ সালে। ওই বছর অনুষ্ঠিত ২৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন আশরাফ। সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষাও দিয়েছিলেন তিনি। পরে চূড়ান্ত বাছাইয়ের জন্য মনোনীত হলে ২০০৩ সালের ৮ আগস্ট মৌখিক পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ হয় আশরাফের।
কিন্তু এখানেই তার ভাগ্য সহায় হয়নি। জানা যায়, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে নির্ধারিত কোটার বিপরীতে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন আশরাফ। তার ভাষায়, ২০০১ সালে নেয়া তার পিতার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সিল-স্বাক্ষর ছিল। তখনো মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন হয়নি। পরে এ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় গঠন করা হলে সেখান থেকে সার্টিফিকেট নিতে হতো। কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে সার্টিফিকেট নেয়া সম্ভব হয়নি। তার কাছে থাকা পূর্বের সার্টিফিকেট নিয়েই তিনি মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে যান। ওই সময় বোর্ডে থাকা সদস্যরা তার সার্টিফিকেটটি নাকচ করে দেয়া। হতাশ হয়ে ফিরে আসেন তিনি। ২০০৩ সালে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনার পর দিনের পর পর দিন কেটেছে আশরাফের। কিন্তু হতাশ হননি। অপেক্ষায় থেকেছেন বছরের পর বছর। আশায় বুক বেঁধেছেন। বিশ্বাস করেছেন- একদিন তিনি সুবিচার পাবেন। নিশ্চয়ই হবেন বিসিএস ক্যাডার।
মাঝখানে অবশ্য কিছুটা আলোর আলো জ্বলেছিল। কিন্তু আইনী মারপ্যাচের লড়াইয়ে পেরে উঠেননি তিনি। জানা যায়, সবখানে ব্যর্থ হয়ে নিয়োগের আশায় পিএসসি’র শরণাপন্ন হন আশরাফ। কিন্তু সেখানে কোনও প্রতিকার না পেয়ে ২০১১ সালে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। এই রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট আশরাফুল ইসলামের পরীক্ষা নিতে পিএসসিকে নির্দেশ দেন। কিন্তু হাইকোর্টের ওই নির্দেশের বিরুদ্ধে রিভিউ দায়ের করে পিএসসি।
২০১৪ সালে পিএসসি’র সেই আবেদনটি শুনানি নিয়ে খারিজ করে দেন আদালত। তাতে ৩০ দিনের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে আদালত মৌখিক পরীক্ষায় ক্যাডারের জন্য বিবেচিত না হলে নন-ক্যাডারে যোগ্য বিবেচনা করতে আদেশ দেন। কিন্তু এরপরও পিএসসি পরীক্ষা নেয়ার কোন ব্যবস্থা করেনি। পরে আশরাফুল ইসলাম পিএসসিতে আদালতের রায়ের কপিসহ ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আবেদন করেন। পরে তার মৌখিক পরীক্ষার কার্ড ইস্যু করার জন্য পিএসসি থেকে পড়ে। তিনি উপস্থিত হয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন।
বিসিএসে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত আশরাফুল ইসলামের বঞ্চনার গল্প
আজ ২৭ নভেম্বর আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘পিএসসি’র রিভিউ খারিজ হলেও তারা আমার পরীক্ষা নিয়ে গড়িমসি করে। অতঃপর ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি তারা আমার মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করে।’ অর্থাৎ প্রিলিমিনারী দেয়ার দীর্ঘ ১৫ বছর ভাইভা দেয়ার সুযোগ পান আশরাফ। সে সময় আবেগঘন এক স্ট্যাটাসে আশরাফ লিখেছিলেন, ‘এ এক অন্যরকম অনুভূতি, আমার জীবনে একটি বিশেষ দিন। ১৫ বছর পর আজ বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষার কার্ড পেলাম। ২৪তম বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করেছিলাম ২০০১ সালে। প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করেও সে সময়ে ভাইভা দিতে পারিনি। এরপর আইনি লড়াইয়ে কেটে গেছে ১৫টি বছর। ফিরে এসেছে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। আগামী জানুয়ারিতে আমার ভাইভা পরীক্ষা নেবে পিএসসি। এত দীর্ঘ সময় পর দেশে কিংবা বিদেশে আর কারও ভাইভা পরীক্ষা দেয়ার এমন নজির আছে কি-না আমার জানা নেই।’
মৌখিক পরীক্ষা ঠিকই নিয়েছিল পিএসসি, কিন্তু সেই ফল আজ অবধি প্রকাশ করা হয়নি। আশরাফ জানায়, সবকূল হারিয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে পিএসসির অনিচ্ছা এবং ব্যর্থটাকে চ্যালেঞ্জ করে গত ২২ নভেম্বর পুনরায় হাইকোর্টে রিট দায়ের করি। সেই রিটের শুনানি নিয়ে আজ ২৭ নভেম্বর আদালত আমার নিয়োগের বিষয়ে রুল জারি করেন।’
‘মো. আশরাফুল ইসলামকে কেন নিয়োগ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে আজ রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট’
রুলে ২৪তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়া আশরাফুলকে কেন নিয়োগ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পিএসসি’র চেয়ারম্যান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার), পিএসসি’র পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট নাজমুল হুদা।
জানা গেছে, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নাতাবাড়িয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. আমজাদ হোসেনের ছেলে আশরাফুলের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে ছিল প্রশাসন ক্যাডার। ২৪তম বিসিএসের এ ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা বর্তমানে সরকারের সিনিয়র সহকারী সচিব। আর এই বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা এখন বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার (এসপি)। অথচ চাকরিটাই কপালে জোটেনি আশরাফুল ইসলামে।