একত্ববাদের অনন্ত রহস্য
কাযবিন ইরানের একটি প্রদেশের নাম। কাযবিনের লোকদের নিয়ে অতীতের একটি গল্প ছিল বেশ মুখরোচক। মওলানা রুমি (রহ.) গল্পটিকে উপলক্ষ বানিয়েছেন তার জীবন দর্শন ব্যাখ্যা করার জন্য। কাযবিনীদের মাঝে রেওয়াজ ছিল, তারা শরীরে বাঘ, সিংহ, নেকড়ের নকশায় উল্কি আঁকত। এর দ্বারা তারা নিজের সাহস ও বীরত্ব প্রকাশ করত। একবার এক কাযবিনী এক আঁকিয়ের কাছে গিয়ে বলল, আমার শরীরে বাঘের একটি ছবি আঁক। আঁকিয়ে বলল, কোথায় আঁকব। কাযবিনী বলল, আমার কাঁধের উপর। আঁকিয়ে উল্কি আঁকতে গিয়ে যেই না সুই ফুটাল, কাযবিনী কঁকিয়ে উঠল। বলল, বাঘের কোন অঙ্গটি আঁকছ, এত যে কষ্ট পেলাম? আঁকিয়ে বলল, লেজ থেকে শুরু করেছি। কাযবিনী বলল, না। লেজটা বাদ দিয়ে আঁক। আঁকিয়ে দ্বিতীয়বার সুই ফুটাল। কাযবিনীর আবার আর্তচিৎকার। বলল, এখন কোন অঙ্গটি আঁকছ। ব্যথা যে সইতে পারছি না। আঁকিয়ে বলল, বাঘের কান। কাযবিনী বলল, আচ্ছা কানটি বাদ দিয়ে আক, কোনো অসুবিধা হবে না। আঁকিয়ে আবার শক্ত করে সুঁই ফুটিয়ে উল্কি আঁকা শুরু করল। এবারও কাযবিনী কঁকিয়ে উঠল। জানতে চাইল, বাঘের কোন অঙ্গটি আঁকছে, এত যে ব্যথা। আঁকিয়ে জানাল, বাঘের পেট। কাযবিনী বিনয়ে অনুরোধ জানাল, বাঘের পেটটি বাদ দিয়ে আমার শরীরে উল্কি আঁক। আঁকিয়ে দারুণ গোস্বায়, তার সুইটি ছুড়ে মারল।
গল্পের এ স্তরে এসে মওলানা মানবজাতির দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নিতে চান অন্য জগতের দিকে। বলছেন,
হে ভাই, তুমি ধৈর্য ধর সুই ফুটানোর তীক্ষ্ণ ব্যথায়, যাতে
মুক্তি পাও অবাধ্য নফসের হুলের তীব্র আঘাত হতে।
তোমার ভেতরে যে নফস হরদম তোমাকে মন্দের দিকে প্ররোচনা দেয়, তাকে বশে আনতে হবে। তার জন্য তোমাকে সাধনা করতে হবে। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। কঠিন কঠোর কৃচ্ছ্রতার তালিম তোমাকে তামিল করতে হবে। কৃচ্ছ্রতার এসব কষ্ট বিষাক্ত কাঁটার দংশনের মতো বলেই মনে হবে। কিন্তু নিজের জীবনকে শুদ্ধ করতে হলে, তোমার ভেতরে অবাধ্য যে নফস হরদম তোমাকে মন্দের দিকে টানছে, তার বিরোধিতা করতে হবে। তাহলেই নফসের আঘাত থেকে তুমি রেহাই পাবে। দিনের পথে চলার, আল্লাহর পথে টিকে থাকার এটিই সহজ ও একমাত্র পথ। এরই অপর নাম জিহাদে আকবর, সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ। আধ্যাত্মিক সাধনার এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কারণ নফসের রঙ-রূপ নিত্য বদলায়। নানা আঙ্গিকে সে মানুষের সামনে উপস্থিত হয়। কাউকে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লোভ গোমরাহ করে, কাউকে ইবাদত-বন্দেগির অহমিকা ও ধোঁকায় ফেলে বিচ্যুত করে। কাউকে জ্ঞানের বড়াইয়ের জালে বন্দি করে। আবার কাউকে ভোগ এবং যৌনতার অন্ধকারে আটকে রেখে সত্য ও সুন্দরের পথ থেকে অন্যদিকে নিয়ে যায়। কাজেই মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় জিহাদ হচ্ছে নফসের এ বিচিত্র ধোঁকা থেকে আত্মরক্ষার সাধনা। নিজের আত্মা, চিন্তা ও চরিত্রকে শুদ্ধ ও সংশোধন করা। কোরআনেও নিজের কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য বারবার এ তাগিদ দেয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, ‘তোমরা কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না, তাহলে ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে।’ (সূরা নিসা : ৩৫)।
বস্তুত কামনা-বাসনার ফাঁদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ মুজাহাদা বা কৃচ্ছ্রসাধনার জাঁতাকলে নফসকে পিষ্ট করা। মওলানা বলছেন, এ জগতে ইবাদত-বন্দেগি, আল্লাহ ও রাসুলের আদেশ-নিষেধ পালনের কঠিন কষ্টভোগ কর তাহলে ওই জগতের দুঃখকষ্ট থেকে তুমি রেহাই পাবে।
কষ্ট কর, সাধনা কর, যাতে পাও তুমি,
আম্বিয়া ও আউলিয়াদের সেই পথ খুঁজি।
আমি কাফের হয়ে যাব, মুহূর্তের জন্যও যদি
ঈমান, ইবাদতের পথে চলে হয় কারো ক্ষতি।
মওলানা বুঝিয়ে বলছেন, যারা নিজের বস্তুগত অস্তিত্ব ও স্বভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছেন, বিবেকের শাসনে প্রবৃত্তিকে আজ্ঞাবহ করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের মহত্ত্বের সামনে যেন আকাশ, চাঁদ, সুরুজ সিজদায় অবনত হয়েছে।
শেখ সাদি (রহ.) বলেন, এক দরবেশকে বাঘের পিঠে সওয়ার দেখে উৎসুক জনতা জিজ্ঞেস করল, কীভাবে আপনি এমন মর্তবা অর্জন করলেন? বুজুর্গ বললেন, আমি নিজেকে আল্লাহর হুকুম পালনে একান্ত বাধ্যগত করে নিয়েছি, যার ফলে আল্লাহর সৃষ্টি আমার অনুগত হয়েছে।
মওলানা রুমি আরও বুঝিয়ে বলেন, যার অন্তরজুড়ে আল্লাহর প্রেমের আগুন লেলিহান শিখায় প্রজ্বলিত হয়, সূর্যের প্রখর তাপ বা প্রাকৃতিক নানা উপাদান তার কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারে না।
মওলানা এ পর্যায়ে কোরআন মজিদে বর্ণিত আসহাবে কাহাফের ঘটনা উল্লেখ করে বলেছেন, জালেম বাদশাহর সম্মুখে সত্যের সাক্ষ্য দিয়ে পালিয়ে থাকা গুহাবাসী এই যুবকদের ওপর সূর্যের তাপ ও চাঁদের আলো এমনভাবে পতিত হত, যাতে তাদের শরীরে বা আরামের ঘুমে সামান্যতম আঁচড় না লাগে।
মওলানা আরও বলছেন, কৃচ্ছ্রতার মাহাত্ম্য এতই সুদূরপ্রসারী যে, কৃচ্ছ্রতার প্রভাবে তুমি ফুলের মতো সৌরভ বিলাবে। যদিও এর আগে তোমাকে কাঁটার মতো মনে হত। তুমি মহাসৃষ্টির ক্ষুদ্র অংশ বটে; কিন্তু কৃচ্ছ্রতার বলে তুমি নিজেকে এতখানি উন্নত করতে পারবে যে, তুমি সমগ্রের মাঝে বিলীন হতে পারবে। সমগ্রের যে গুণ ও বৈশিষ্ট্য তখন তা তোমার মধ্যে সঞ্চারিত হবে। সেই সমগ্রের সামনে তুমি সত্যিকার সান্নিধ্যে উপনীত হবে। তার সম্মুখে শ্রদ্ধায় অবনত হতে পারবে।
আমরা যে নামাজ পড়ি, আল্লাহর সামনে রুকুতে নত হই, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সিজদায় যাই, তাতে আমাদের উপলব্ধি এটাই। আমরা নিজেকে হীন, তুচ্ছ ও মাটিতে পতিত বলেই অনুভব করি মহামহিম আল্লাহর সমীপে। এটিই তাওহিদের মর্মবাণী। মওলানা রুমি বলছেন, আল্লাহর তাওহিদ বা একত্ববাদ হলো, নিজেকে পরম এককের সামনে পুড়ে ছাই করা। অর্থাৎ নিজের কাল্পনিক অস্তিত্বের পতন ঘটানো এবং আল্লাহর প্রেমের অনলে দগ্ধ হওয়া আর ফানার (আত্মবিলীন) মাকাম লাভ করা।
এই মাকাম লাভ করার একটি উপায় আছে। মওলানা সেটি বুঝিয়ে বলছেন এভাবে-
চাও যদি আলোকিত হবে উজ্জ্বল দিবসের মতো
জ্বালিয়ে দাও তোমার অস্তিত্ব, যা কিনা রাতের মতো।
তুমি যদি চাও যে, দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হবে, সত্যের আলোতে দেদীপ্যমান হবে, তাহলে তোমার বস্তুগত অস্তিত্বের কিছুই যাতে নফসের কামনা-বাসনায় বন্দি হওয়ার সব জাল ছিন্ন কর।
তোমার অস্তিত্ব সেই পরম অস্তিত্ব দাতার সম্মুখে
পরশমণিতে তামার মতো বিগলিত কর জ্বালিয়ে।
তামা যেমন আগুনে জ্বলে বিগলিত হয় এবং খাঁটি স্বর্ণ উদ্ভাসিত হয়, তেমনি তুমিও তোমার অস্তিত্বের তামাকে পরম অস্তিত্ব আল্লাহর পরশে বিগলিত কর।
আমি ও আমরায় করেছ নিজকে দারুণ বিভাজিত
সব অনিষ্টের মূলে কিন্তু ক্রিয়াশীল দেখ এই দ্বিত্ব।
অর্থাৎ তুমি নিজের মিথ্যা অস্তিত্বের বন্দিত্বের মধ্যে আটকে আছ। বুঝতেই পারছ না যে, নিজকে আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা মনে করার কারণে সব ধরনের মানসিক ও চারিত্রিক বিপর্যয় তোমার ওপর আপতিত হচ্ছে। কাজেই আল্লাহর মোকাবিলায় নিজেকে কিছু একটা বলে ভাবার চিন্তা ঘৃণাভরে ত্যাগ কর।
(সূত্র : মসনবি শরিফ, বয়েত-১/২৯৮১-৩০১২)