ধর্ম ও জীবন

ফকির থাকেন পাগল সেজে

একদা এক ব্যক্তি কোনো জ্ঞানী লোকের সন্ধান করছিল। জিনের বড় একটি সমস্যায় জ্ঞানী লোকের পরামর্শের প্রয়োজন ছিল তার। লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করছিল, এমন লোকের সন্ধান কীভাবে পাওয়া যায়? এক লোক বলল, এ শহরে মাত্র একজন জ্ঞানী লোক আছেন। কিন্তু থাকেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। তিনি পাগলের ছদ্মবেশ ধরে ঘোরেন। হাতে তার বাঁশের একটি কঞ্চি। সেটিকে ঘোড়া বানিয়ে তার উপর চড়ে দৌড়ান। ছেলেদের কাছে গিয়ে বলেন, এটি আমার ঘোড়া। ওই দেখুন, দুই পায়ের মাঝখানে কঞ্চি চেপে দৌড় দিচ্ছেন: ‘হুররা। এই আমার ঘোড়া।’ আসলে লোকটি জ্ঞানী। পাগলের বেশ ধরে আত্মগোপন করে আছেন।

সন্ধানী লোকটি কঞ্চি আরোহী পাগলের দিকে এগিয়ে গেলেন। ডাক দিয়ে বললেন, হে অশ্বারোহী! আপনার ঘোড়াটা একটু আমার দিকে ঘোরান দেখি। তৎক্ষণাৎ কঞ্চির ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে পাগল হাজির। বলল, জলদি বল, কী চাই তোমার। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারব না। আমার ঘোড়ার পাগলামি আছে। সে অবাধ্য। পায়ের আঘাতে তোমাকে ফেলে দেবে। লোকটি বলল, আমার জানার বিষয়টি হলো এ মহল্লায় আমি বিয়ে করতে চাই। আপনার মতে, কোন ধরনের পাত্রী আমার জন্য ভালো হবে? ছদ্মবেশী পাগল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, সমাজে তিন ধরনের মেয়ে আছে। এর দুই ধরনের নিয়ে শান্তি নাই, কপালে দুঃখ লেখা। তৃতীয় ধরনের মেয়ে তোমার জন্য সম্পদের খনি, সৌভাগ্যের ধন। এ তিন কিসিমের মহিলার মধ্যে যে প্রথম ধরণকে বিয়ে করবে, সে স্ত্রী হবে সম্পূর্ণ তোমার। তার রূপগুণ একা তুমি ভোগ করবে। দ্বিতীয় ধরনের স্ত্রীর অর্ধেক তোমার আর অর্ধেক অন্যের। তৃতীয় ধরনের স্ত্রীর কথা বলি, তোমার আর তার মধ্যে এতই দূরত্ব হবে, যেন তোমার সঙ্গে তার আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। জবাব শুনলে তো। এবার জলদি চলে যাও। নতুবা আমার ঘোড়া পদাঘাত করবে তোমাকে। একথা বলেই পাগল ছুটল তার কঞ্চির ঘোড়া নিয়ে। ছেলেপেলের দলে গিয়ে খেলায় সে আবার মশগুল হলো।

প্রশ্নকারী একেবারে হতভম্ব। কিছুই বুঝতে পারলেন না এ জবারের গূঢ়রহস্য। তাই তিনি দৌড় দিলেন পাগলের পেছনে। কাছে গিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জনাব, আরেকটু আসুন। আপনি যে কথাগুলো বললেন। আমার তো বুঝে এলো না। দয়া করে একটু ব্যাখ্যা করুন। পাগল আবার ছুটে এলো তার কাছে। বলল, প্রথম যে স্ত্রীর কথা বলেছি, যে পুরোপুরি তোমার হয়ে যাবে, সে হলো অবিবাহিতা কুমারী মেয়ে। রূপে-গুণে-ব্যবহারে সে তোমাকে আনন্দে ডুবিয়ে রাখবে। দ্বিতীয় ধরনের যে স্ত্রীর কথা বলেছি, সে হলো কোনো বিধবা নারী। যদি কোনো বিধবাকে তুমি বিয়ে কর, তাহলে তার অর্ধেকটা তুমি পাবে, বাকি অর্ধেক থাকবে অন্যের। তার মনের অর্ধেকটা থাকবে আগের স্বামীর কাছে। তৃতীয় যে মহিলার কথা বলেছি, সে হলো এমন মহিলা, যার আগের স্বামীর ঘরের শিশুসন্তান কোলে আছে। কোলের শিশুর কারণে মহিলার মন বারে বারে সন্তানের বাবা, আগের স্বামীর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠবে।
পাগল বলল; ব্যাখ্যা শুনলে তো, সরে যাও। আমার ঘোড়ার পথ ছেড়ে দাও। তোমার গায়ে যেন লাথি না মারে। একথা বলে চলে গেল ছেলেদের দলে।

ছদ্মবেশী পাগলের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তায় লোকটি হতবাক। তার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। এতবড় জ্ঞানী লোক কেন এভাবে পাগলের বেশে ছেলেপেলের দলে মিশে আছে, জানতে হবে। তাই তিনি এগিয়ে গেলেন পাগলের দিকে। ডাক দিলেন, হে ঘোড়-সওয়ার বন্ধু! আরেকটি প্রশ্ন আছে। জবাব দিন। তারপর চলে যাব। ছদ্মবেশী পাগল বলল, জলদি বল। আমার সময় নেই। বললেন, আচ্ছা আপনার যে এত জ্ঞানবুদ্ধি, প্রজ্ঞা, তারপরও এসব ছেলেমি-পাগলামি করেন কেন? এর পেছনে কারণ কী? জবাব দিল, এ অসভ্যটা (তখনকার শাসক) চাচ্ছে যে, আমাকে শহরের কাজী পদে নিয়োগ দেবে। তখন বিচারকের এজলাসে বসে তার মর্জি মতো আমাকে ফয়সালা দিতে হবে। বহু চেষ্টা করেছি, যাতে এ দায়িত্ব এড়ানো যায়। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। আমাকে রেহাই দেবে না। কাজেই উপায়ান্তর না দেখে এ পথ বেছে নিয়েছি। পাগলের বেশ ধারণ করেছি। যাতে এ জালেম শাসকের অধীনে জজের পদ গ্রহণ করতে না হয়। এসব জালেম গোমরাহিরা আমাকে ডাকছে তাদের জুলুম-অত্যাচারে সাহায্য করার জন্য, যদি তার মোকাবিলায় নিজে পাগলের বেশ ধারণ না করি, তাহলে আমিই হব আসল পাগল। শুধু আমি নই, যে কেউ এসব জালেম জল্লাদদের দেখে নিজের জ্ঞানের হেফাজতের জন্য পাগলের বেশ ধারণ করে না, আসলে সে পাগল এবং চরম মূর্খ। কারণ, আসল জ্ঞান সেটি, যা হাকিকতের সঙ্গে মিশ্রিত থাকে। হাকিকত মানে পরম সত্য, তাৎপর্য ও সারসত্তা। যে জ্ঞান পেশাগত অর্থ উপার্জনের জন্য, তা জৈবিক চাহিদা পূরণের হাতিয়ার ছাড়া অন্য কিছু নয়। আমার জ্ঞান প্রথম প্রকারের, যা হাকিকতের সঙ্গে মিশ্রিত। সেটিই সৌভাগ্যের পরশমণি। আমার এ জ্ঞান দ্বিতীয় ধরনের নয়। সেটি অর্থ উপার্জনের পণ্য। আমার এ অমূল্য জ্ঞান আমি আল্লাহর পরম সৌন্দর্যের সঙ্গেই বিনিময় করি। হালাল উপার্জনেই ব্যয় হয় আমার দক্ষতা, পা-িত্য। শয়তানের সহযোগী হয়ে আমার জ্ঞান হারাম উপার্জনের পথে যায় না।

আমার জ্ঞান হলো রতে্নর খনি; আর আমি বিরানভূমি। পতিত বিরান ভূমিতেই লুকিয়ে থাকে অনন্ত রত্নখনি। কাজেই আমি যদি ভেতরের রত্নখনি প্রকাশ করে দিই, তাহলে পাগল সাব্যস্ত হব। পাগল ছাড়া কেউ নিজের গুপ্তধন অন্যের কাছে খুলে দেয় না। আমার জ্ঞান অমূল্য রতন। আজেবাজে জিনিস খরিদ করার জন্য ওই অমূল্য রত্ন ব্যয় করব না। বরং এ অমূল্য রত্ন দিয়ে খরিদ করব, পরম আরাধ্যের প্রেম ও সন্তুষ্টি। আমার ক্রেতা স্বয়ং আল্লাহ। তিনিই আমাকে নিয়ে যাবেন উপরের দিকে-জান্নাত কাননের পানে। সূরা তওবায় সে কথাই বলেছেন।
‘আল্লাহ মোমিনদের কাছ থেকে তাদের জান ও মাল খরিদ করে নিয়েছেন চির সুখের জান্নাতের বিনিময়ে।’

কাজেই জ্ঞানকে আল্লাহর দ্বীনের জন্য রাসুলে পাকের দেখানো পথে, আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিয়োজিত করতে হবে। দুনিয়ার কাদামাটিতে লুটোপুটু খাওয়ার জন্য নয়। তবে আল্লাহর একান্ত দয়ার হাতছানি ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই আল্লাহর দরবারে মওলানা রুমির আকুতি!

‘দস্তগীর আয দস্তে মা’ মা’ রা’ বেখার
পর্দা রা’ বরদা’র ও পরদায় মা’ মাদার’
‘বাঁচাও, বাঁচাও, রেহাই দাও নিজ হাত হতে আমাকে,
পর্দা সরাও, লজ্জা দিওনা আমার সম্ভ্রমের পর্দা ছিঁড়ে।’

আমার হাত ধর, বাঁচাও, উদ্ধার কর। আমার হাত থেকে আমাকে খরিদ করে নাও। নফসে আম্মারার কবল থেকে, বস্তুগত অস্তিত্বের জিঞ্জির থেকে আমাকে মুক্তি দাও। তোমার আমার মাঝখানের পর্দাখানি সরিয়ে দাও। আমার মানসম্ভ্রমের পর্দা ছিন্ন কর না। লজ্জিত কর না। আমার জারিজুরি যেন ফাঁস হয়ে না যায় সমাজে, মানুষের কাছে।
(সূত্র : মসনবি শরিফ, ২য় খণ্ড, বয়েত নং ২৩৩৮-২৪৪৪)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button