টপ লিডদেখা-অদেখা

হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের মধুবৃক্ষ

ঝিনাইদহের চোখঃ

হেমন্ত ঋতুকে বলা হয় হেমন্তলক্ষ্মী। এ ঋতুতেই কৃষকের ঘরে নতুন ফসল ওঠায় আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। পালিত হয় নবান্ন উৎসব।

হেমন্তের মাঝামাঝি সময় থেকেই খাঁ খাঁ ফসলশূন্য মাঠে, গাছের পাতায় কিংবা দূর্বাঘাসের ডগায় জমতে শুরু করে শিশিরবিন্দু। সকালের মিষ্টি রোদ ভোরের শিশিরবিন্দুর ওপর পড়ে সৃষ্টি করে হীরের ছটার মতো এক অপার্থিব সৌন্দর্য।

উত্তরের হিমেল হাওয়া হেমন্তকে বিদায় জানিয়ে গুটি গুটি পায়ে বাংলার প্রকৃতিতে নিয়ে আসে শীতের আগমন বার্তা। শীতকাল ষড়ঋতুর পঞ্চম ঋতু। পৌষ-মাঘ মিলেই প্রকৃতি ও জীবনের শরীরে সৃষ্টি করে শীতের অন্যরকম এক মোহনীয় সৌন্দর্য।

ঋতুবৈচিত্র্যে এখন চলছে শীতকাল। আর শীতকালের বড় একটা অংশজুড়ে রয়েছে নানারকমের শাকসবজি ও খেজুরের রস। অন্যান্য ঋতুর তুলনায় এই ঋতুতে সবচেয়ে বেশি শাকসবজি উৎপাদিত হয়।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, গাজর, মুলা, পালংশাক, বেগুন, শিম ইত্যাদি। তবে শীতকালের একটি বড় আকর্ষণ যা সবার মন জয় করে নেয় সেটা হল খেজুরের রস, রস থেকে বানানো গুড়-পাটালি আর নলেন গুড়ের সন্দেশ। গুড় দিয়ে যে সন্দেশ তৈরি হয় তা অনেকেরই অজানা।

আর সে সন্দেশ একবার যদি কেউ চেখে দেখে তাহলে সারা জীবন তার স্বাদ মুখে লেগে থাকবে। তবে খেজুরের গুড়-পাটালিও কম স্বাদের নয়। তাই খেজুর গাছকে মধুবৃক্ষ বললে অত্যুক্তি হবে না।

শীতকালে বাংলার প্রতিটি গ্রাম খেজুর রসের পিঠা-পায়েসের উৎসবে মেতে ওঠে। দূরদূরান্ত থেকে মেয়ে-জামাই শামিল হয় সেই উৎসবে। শহরে থাকা ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা গ্রামে ফিরতে ভুল করে না।

কবে কখন বাঙালির সত্তার সঙ্গে খেজুর রসের পিঠা-পায়েস মিলেমিশে একাকার হয়েছে তা আজ আর কেউ খুঁজে দেখে না। বাংলার ঐতিহ্য পিঠা-পায়েসের আনন্দটাই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খেজুর গাছের দেখা মিললেও বৃহত্তর যশোর জেলায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি। নড়াইল, মাগুরা, যশোর, ঝিনাইদহ শহরগুলো ছেড়ে একটু ভেতরে গেলেই চোখে পড়বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছের সারি।

গাছের মাথায় বাঁধা রয়েছে কলস অথবা হাঁড়ি। টপ টপ করে রস পড়ছে। কোনো তৃষ্ণার্ত পাখি নলের ওপর বসে সুমিষ্ট এই রস মজা করে পান করছে। আবার গাছ জড়িয়ে ধরে গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হা করে রস খাওয়ার অপূর্ব দৃশ্য অহরহ চোখে পড়ে।

খেজুর গাছের মিষ্টি রস পেতে গাছের উপরিভাগের নরম অংশ কেটে সেখানে বসিয়ে দেয়া হয় বাঁশের তৈরি নল। গাছের কাটা অংশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে নল দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রস জমা হয় কলসিতে।

রাতভর জমা হওয়া রস কাকভোরে সংগ্রহ করতে উপস্থিত হয় গাছি। কুয়াশায় মোড়ানো শীতের সকালে বাঁক কাঁধে বিস্তীর্ণ মাঠের সরুপথ দিয়ে গাছির বাড়ি ফেরার দৃশ্য যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমীকে মুগ্ধ করবে।

রস সংগ্রহ শেষে আগুনে জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় গুড়-পাটালি। দেশের মধ্যে যশোরের খেজুরের গুড়-পাটালি দেশ ছেড়ে বিদেশেও সুনাম কুড়িয়েছে। নলেন গুড়ের সন্দেশও তাই।

‘ঠিলে ধুয়ে দেরে বউ গাছ কাটতি যাব

সন্ধ্যের রস ঝাড়ে আনে জাউ রান্দে খাব…’

যশোর জেলার খেজুর রস মানুষের মনে এতটাই দাগ কেটেছে যে তা নিয়ে গানও রচিত হয়েছে। শীতকাল এলেই যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা এই গানের কথা প্রায় সবার মুখে মুখে শোনা যায়। গানটির কথা বারবার মনে করিয়ে দেয় লোভনীয় খেজুর রসের কথা, গুড়-পাটালির কথা, সন্দেশের কথা।

‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’ -এমন প্রবাদই প্রমাণ করে যশোরের খেজুর রসের জনপ্রিয়তা। তবে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে বাদুড় দ্বারা সংক্রমিত নিপা ভাইরাস থেকে। জ্বাল দিয়ে ফোটানো খেজুরের রস সবাই যেন খায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তৎকালীন অবিভক্ত ভারতেও যশোরের খেজুরের গুড়-পাটালির জন্য বিখ্যাত ছিল। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ‘একসময় যশোর অঞ্চলের প্রধান কৃষিজ পণ্য ছিল খেজুরের গুড়। ১৯০০-২০০১ সালে পুরো বঙ্গে খেজুরের গুড় উৎপাদিত হতো ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ।

এর মধ্যে কেবল যশোরেই উৎপাদিত হতো ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ মণ, সেই সময় যার দাম ছিল ১৫ লাখ টাকা। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এই গুড় আমেরিকা-ইউরোপেও রফতানি হতো। খেজুর গাছের জন্যই অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্রামগঞ্জে গড়ে উঠেছিল গুড় তৈরির হাজারো কারখানা।

১৮৬১ সালে প্রথম চৌগাছার তাহিরপুরে কপোতাক্ষ নদের ধারে খেজুরের রস দিয়ে চিনি উৎপাদনের যান্ত্রিক কারখানা গড়ে ওঠে। এ কারখানায় উৎপাদিত চিনি ইউরোপে রফতানি হতো।’

বাংলার ঐতিহ্যের অহংকার মধুবৃক্ষ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। আশপাশে, রাস্তার দুধারে, ফসলি জমির আলে আগের মতো খেজুর গাছ দেখা যায় না।

মূল্য কম আর যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো বৈধ-অবৈধ ইটভাটায় খেজুর গাছের চাহিদা থাকার কারণে অনেকেই অপ্রয়োজনীয় গাছ বলে বিক্রি করে দিচ্ছে।

আবার কেউ কেউ শুধু শীত মৌসুমে রস পাওয়ার আশা না করে অধিক লাভবান হওয়ার আশায় খেজুর গাছ বিক্রি করে সেখানে রোপণ করছে বিদেশি প্রজাতির গাছ, যা আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

একবার দেশি প্রজাতির বাগান ধ্বংস হয়ে গেলে সেখানে কৃত্রিমভাবে বাগান তৈরি করা যায় ঠিকই কিন্তু তা কখনই মূল দেশি প্রজাতির বাগান হয় না।

বাঙালির ঐতিহ্যের অহংকার খেজুর গাছ আজ অসচেতনতা, অবহেলাসহ বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। খেজুরগাছ হারিয়ে গেলে খেজুরের রসও হারিয়ে যাবে। তাহলে কী বাঙালির অহংকার খেজুর রসের পিঠা-পায়েসের উৎসব আমরা ধরে রাখতে পারব না!

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button