ধর্ম ও জীবন

ভোট প্রদানে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

ঝিনাইদহের চোখঃ
নেতা বা দায়িত্বশীল নির্বাচনে ভোট একটি পবিত্র আমানত। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’- ভোট প্রদানে এমন বক্তব্য বা মনোভাব ইসলাম সমর্থন করে না।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় ভোটের গুরুত্ব অপরিসীম। এ ভোট প্রদানের মাধ্যমেই মানুষ তাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় একজন প্রতিনিধিকে দায়িত্ব প্রদান করে। যে প্রতিনিধি মানুষের কল্যাণে কাজ করবে।

ভোট যেহেতু মানুষের পবিত্র আমানত। আর এ ভোট প্রদানের মাধ্যমে একজন প্রতিনিধি সমাজের দায়িত্বশীল হবে। সুতরাং মানুষের প্রতিনিধিকে হতে হবে অবশ্যই সৎ, যোগ্য, সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও দায়িত্বপালনে নিরপেক্ষ। সর্বোপরি দায়িত্ব পালনে অন্তরে জবাবদিহিতার ভয় পোষণকারী।

অসৎ অযোগ্য অশিক্ষিত ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে প্রনিতিধি নির্বাচন করলে জাতির ভাগ্যে মন্দ বা ধ্বংসাত্মক ছাড়া ভালো কিছু হবে না।

আর খারাপ ব্যক্তি যদি প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে খারাপ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে তবে দুনিয়া ও পরকালে অকল্যাণ ছাড়া কোনো কিছুই পাবে না ভোট প্রদানকারী ব্যাক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র।

আর যারা অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেবে তার (প্রতিনিধির) সব অযোগ্যতার মন্দ পরিণতিও ভোটদানকারীকেই বহন করতে হবে। সুতরাং ভোট প্রদানের ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো-

ইসলামের দৃষ্টিতে ভোট হচ্ছে ৩টি বিষয়ের সমষ্টি-
> সাক্ষ্য প্রদান করা
> সুপারিশ করা
> প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা প্রদান করা

সাক্ষ্য প্রদান
প্রতিনিধি নির্বাচনে যারা ভোট প্রার্থী, তাদের মধ্য থেকে কোনো একজনকে ভোট দেয়ার অর্থ হলো- এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, লোকটি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনে সৎ ও যোগ্য।

পক্ষান্তরে অযোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেয়ার অর্থই হলো মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা। যা শরিয়তের দৃষ্টিতে অনেক বড় অপরাধ ও গোনাহের কাজ। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সাক্ষ্য প্রদানে সত্য, ন্যয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন-

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য প্রদানে ন্যয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যদিও তা তোমাদের নিজেদের কিংবা পিতা-মাতা অথবা নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে হয়। যদি সে বিত্তশালী হয় কিংবা দরিদ্র হয়। তবে আল্লাহ উভয়ের ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং ন্যয় প্রতিষ্ঠা করতে তোমরা প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা (প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে) এড়িয়ে যাও তবে (জেনে রেখ) তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১৩৫)

এভাবে কুরআনের অনেক আয়াতে ন্যয়সঙ্গত সাক্ষ্য প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট প্রদানে অসৎ ও অযোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করলে আল্লাহর কাছে কঠোর জবাবদিহি করতে হবে।

সুপারিশ
ভোট প্রদানে ইসলামের দ্বিতীয় মূলনীতি হলো সুপারিশ করা। কোনো ব্যক্তি ভোট দেয়ার অর্থই হলো যে, সে এ ব্যক্তিকে সৎ ও যোগ্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করছে কিংবা তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে।

প্রতিনিধি নির্বাচনে সুপারিশ প্রদানের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা মানুষকে এমন নির্দেশনা দিয়েছেন যে, এ সুপারিশ দুনিয়া ও পরকালে ব্যক্তির ভালো ও মন্দের সঙ্গে সুস্পষ্ট সম্পর্কিত। আল্লাহ বলেন-

যে ব্যক্তি সৎকাজের জন্য কোনো সুপারিশ করবে তা থেকে (সৎ কাজের) একটি অংশ পাবে। আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজের সুপারিশ করবে সে তার (মন্দ কাজের) একটি অংশ পাবে। আর আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ের সংরক্ষণকারী।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৮৫)

সুতরাং কাউকে সুপারিশ করে প্রনিনিধি নির্বাচন করার পর এ জনপ্রতিনিধি যদি সৎ ও যোগ্যতার সঙ্গে নিরপেক্ষ জবাবদিহিমূলক সমাজ পরিচালনা করে তবে যারা তাকে প্রনিতিধি হিসেবে সুপারিশ করেছে, তারাও তার ভালো কাজের সাওয়াব বা অংশ পাবে।

আর জনপ্রতিনিধি যদি অসৎ অযোগ্য ও নিরপেক্ষহীন কাজ করে, জবাবদিহিতার বিপরীত কাজ করে তবে যারা এ জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুপারিশ করেছে তারাও সব খারাপ কাজের অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। আর এটি মহান আল্লাহর ঘোষণা।

অতএব জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে কাউকে সুপারিশ তথা ভোটাধিকার প্রয়োগের আগে প্রার্থীর যোগ্যতা বিবেচনা করাও ভোটারের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। কেননা ভোটের দ্বারা নির্বাচিত প্রার্থী ভালো মন্দ যা কিছু করবে তা ভোট দাতার আমল নামায়ও যুক্ত হবে।

প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা প্রদান
ভোট প্রদানে ইসলামের তৃতীয় মূলনীতি হলো প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা প্রদান। যে ব্যক্তি নিজে সৎ কিংবা যোগ্য নয়, সে ব্যক্তিকে প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা প্রদানে ভোট দেয়া মারাত্মক জুলুম। কেননা অসৎ ও অযোগ্য নেতৃত্বের সব দায়ভার ভোটারকে বহন করতে হবে।

আল্লাহ তাআলা মানুষকে কুরআনসহ প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। এ কুরআন মানুষের একমাত্র জীবন বিধান। যা মানুষ ছাড়া কেউ কুরআনের এ দায়িত্বভার গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। যেহেতু মানুষ কুরআনের আমানত গ্রহণ করেছে।

সুতরাং মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কুরআন অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব করাই ইসলামের অন্যতম মূলনীতি। আল্লাহ তাআলা মানুষকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন-

‘নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ, জমিন ও পর্বতমালার প্রতি এ (মানুষের জীবন পরিচালনায় ইসলামের বিধি-বিধান পালনের) আমানত পেশ করেছিলাম। কিন্তু তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা তাতে আশংকিত হলো কিন্তু মানুষ সে দায়িত্বভার গ্রহণ করলো। সে বড়ই অন্যায়কারী, বড়ই অজ্ঞ।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ৭২)

মনে রাখতে হবে
ভোট প্রদান করা শুধু ব্যক্তির সঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয় বরং প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনে ভোটার ও প্রার্থীর বিষয়টি ব্যক্তি জীবন থেকে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই ভোটারের যেমন উচিত সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেয়া আবার নির্বাচিত জনপ্রিতিনিধির উচিত ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সার্বিক বিষয়ে সঠিক ও ন্যয়সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। আর বিপরীত হলে ভোটার ও প্রার্থী উভয়কেই অপরাধের দায়ভার ও শাস্তি ভোগ করতে হবে।

সুতরাং ভোট দেয়া কিংবা না দেয়া হারাম, এ সব কথায় বা গুজবে কান না দিয়ে যোগ্য ও সৎ প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে এগিয়ে আসা ঈমানের একান্ত দাবি।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে উত্তম সাক্ষী দানকারীদের সম্পর্কে বলব না? যে তার সাক্ষ্য তার কাছে তলব করার পূর্বেই আদায় করে।’ (মুসলিম)

অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য ও অসৎ লোককে ভোট দেয়ার ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। কেননা ইসলামে তা অনেক বড় গোনাহের কাজ।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের মানসিকতা পোষণকারী ও জবাবদিহিতার মানসিকতা পোষণকারী ব্যক্তিকে ভোট দেয়ার তাওফিক দান করুন। সৎ যোগ্য দেশপ্রেমিক দায়িত্বশীল নির্বাচনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button