ধর্ম ও জীবন

বিপদ দূর করার উদ্দেশ্যে তাবিজ, ধাগা, সুতা ইত্যাদি পরিধান করা শিরক

ঝিনাইদহের চোখঃ

বিশেষ আক্বিদা বিশ্বাস নিয়ে যা কিছুই ঝুলানো বা পরানো হবে সেটি শিরকের অন্তর্ভুক্ত। হোক সেটি বাড়িতে ব্যবহার করা হোক অথবা গাড়িতে ঝুলানো হোক কিংবা ছোট-বড়দের শরীরে পরানো হোক এসবই শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

আরবদের বিশ্বাস ছিল এগুলোতে হয়ত উপকার হয় বিপদ-আপদে পতিত হওয়ার পর তা দূর করার ক্ষেত্রে বা তাতে পতিত হওয়ার পূর্বেই, তা প্রতিরোধ বা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে। আর এ বিশ্বাস হল মারাত্মক। কেননা এতে বিশ্বাস করা হয় যে, এ নগণ্য বস্তু নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলার নির্ধারিত তকদীর বা ভাগ্যও কে প্রতিহত করে।

এ ধরনের বিশ্বাস ছোট শিরক হতে শিরকে আকবার বা বড় শিরকে রূপান্তরিত হয়। কেননা এ বিশ্বাসীর অন্তর সেগুলোর সাথে সম্পৃক্ত এবং সেগুলোকে বিপদ-আপদ হতে উদ্ধার ও তা প্রতিহত করার কারণ বলে মনে করে। এক্ষেত্রে এর সূত্র হল, শরীয়তসম্মত কারণ ব্যতীত ক্রিয়াকারী কোন কারনই সাব্যস্ত করা জায়েজ নয়, অথবা এমন কোন বাস্তব প্রয়োগকৃত স্পষ্ট কারণ হতে হবে যার মধ্যে কোন রূপ অস্পষ্টতা ও গোপনীয়তা নেই। যেমন- ডাক্তারী ওষুধ এমন কোনো মাধ্যম যার উপকার বা ক্রিয়া প্রকাশ্য।

আগুন দ্বারা তাপ গ্রহণ, পানি দ্বারা ঠাণ্ডা বা অনুরূপ কিছু। এসব মাধ্যম প্রকাশ্য যার প্রভাবই স্পষ্ট। কখনো কখনো ব্যক্তির নিয়তের ভিত্তিতে সব ধরনেরই ছোট শিরক বড় শিরকে পরিণত হতে পারে। যেমন- বালা, ধাগা, সুতা পরার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি যদি সেটিকে মাধ্যম মনে না করে সরাসরি তাকেই ক্রিয়াকারী বিশ্বাস করে। অতএব এ অধ্যায় অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত।

মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে রাসূল! আপনি বলুন, তোমরা কী মনে কর, আল্লাহ যদি আমার কোনো ক্ষতি করতে চান তাহলে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ডাকো তারা কি তাঁর নির্ধারিত ক্ষতি হতে আমাকে রক্ষা করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি তাঁর অনুগ্রহ ঠেকাতে পারবে?” (সূরা জুমার-৩৮)

উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা উক্ত সব ধরনের বাতিল মা’বুদদের ক্ষতি ও উপকার সাধনের ক্ষমতাকে বাতিল সাব্যস্ত করেন। অতএব উক্ত মা’বুদগুলির সম্পর্কে মুশরিকগণের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর নিকট তাদের উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। যার ফলে তারা তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে, তা বাতিল ও ভিত্তিহীন সাব্যস্ত হয়।

আল্লাহ ছাড়া কারো এরূপ ক্ষমতা নেই যে, সে কারো কোনো ক্ষতি করতে পারবে বা কোনো উপকার সাধন করতে পারবে। অনুরূপ আল্লাহ কারো ক্ষতি করলে তাঁর বিনা হুকুমে তা থেকে কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারবে না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে উপকার করার ও ক্ষতি করার উপযুক্ত মনে করার এটি অর্থ। যার কারণে মুশরিকগণ রিং, বালা, ধাগা, সুতা ব্যবহার করে থাকে।

ইমরান বিন হুসাইন রাঃ বলেন, রাসূল (সা.) এক ব্যক্তির হাতে একটি পিতলের বালা দেখতে পেলেন। তিনি তাকে বললেন, এটা কী? লোকটি বলল, এটা দুর্বলতা দূর করার জন্য দেওয়া হয়েছে। তিনি বললেন, এটা খুলে ফেলো, কারণ এটা তোমার দুর্বলতাকেই শুধু বৃদ্ধি করবে। আর এটা তোমার সাথে থাকা অবস্থায় যদি তুমি মারা যাও তবে তুমি কখনো সফল হতে (জান্নাতে যেতে) পারবে না। (মুসনাদে আহমদ, ৪র্থ খন্ড, ৪৪৫ পৃঃ)

উকবা বিন আমির রাঃ বলেন, রাসূল (সা.) তাবীয ঝুলানো সম্পর্কে বলেছেন, যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলায় বা পরিধান করে, আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ না করেন। যে ব্যক্তি কড়ি, শঙ্খ বা শামুক ঝুলায়, তাহলে আল্লাহ যেন তাকে রক্ষা না করেন। (মুসনাদে আহমদ, ৪র্থ খণ্ড, ১৫৪ পৃঃ)

অন্যত্রে রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো সে শিরক করল। (মুসনাদে আহমদ, ৪র্থ খণ্ড, ১৫৪ পৃঃ)
আব্দুল্লাহ রাঃ এর স্ত্রী যায়নাব রাঃ, আব্দুল্লাহ রাঃ এর সূত্রে বর্ণনা করেন, আমি রাসূল (সা.)- কে একথা বলতে শুনেছি যে, যাদু, তাবিজ , কবচ, অবৈধ প্রেম ঘটানোর মন্ত্র শিরক- এর অন্তর্ভুক্ত। যায়নাব রাঃ বলেন, আমি বললাম আপনি এসব কী বলেন? আল্লাহর কসম! আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তো। আমি অমুক ইয়াহুদী কর্তৃক ঝাড়ফুঁক করাতাম। সে আমাকে ঝাড়ফুঁক করলে পানি পড়া বন্ধ হয়ে যেতো। আব্দুল্লাহ রাঃ বললেন, এগুলো শয়তানের কাজ। সে নিজ হাতে চোখে যন্ত্রণা দেয়, তখন তোমার চোখ দিয়ে পানি পড়ে। আর যখন সে ইয়াহুদী মন্ত্র পড়ে ফুঁক দেয় তখন সে বিরত থাকে। (সুনানে আবু দাউদ, হাঃ- ৩৮৩৮)

ঈসা ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু আবু লায়লা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি আব্দুল্লাহ বিন উকাইম আবু মা’বুদ আল-জুহানীকে অসুস্থতার জন্য দেখতে গেলাম। তিনি বিষাক্ত ফোঁড়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমি তাকে বললাম, তাবিজ-তুমার ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন? তিনি বললেন, মৃত্যু তো এর চেয়েও কাছে। নবী (সা.) বলেছেন, যে লোক কোনো কিছু ঝুলিয়ে রাখে (তাবিজ, ধাগা, সুতা ইত্যাদি) তাকে তার উপরই সোপর্দ করা হয়। (সুনানে তিরমিযী, হাঃ – ২০৭২)

ইবনে আবী হাতিম রঃ হুযাইফা রাঃ হতে বর্ণনা করেন, জ্বর নিরাময়ের জন্য হাতে সুতা বা ধাগা পরিহিত অবস্থায় তিনি একজন লোককে দেখতে পেয়ে সে সুতা কেটে ফেললেন এবং আল্লাহর এ বাণী পড়ে শুনালেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পরও মুশরিক। ( সূরা ইউসূফ- ১০৬, তাফসীর ইবনু কাসীর, ৪র্থ খণ্ড, ৩৪২ পৃ)

সকল প্রকার তাবিজ-তুমার, বালা, ধাগা ও সুতা নিষিদ্ধ। যে ব্যক্তি তাবিজ-তুমার, বালা, ধাগা ও সুতা হালাল করার জন্যে ফাঁকফোকর খুঁজবে, সে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বান্দা যদি স্বীয় অন্তর থেকে সমস্ত কিছুর ভরসাকে বের করে, একমাত্র আল্লাহর প্রতি ভরসা করে তবে তাতে তার জন্য আনন্দ, মুক্তি ও সফলতা রয়েছে।

লেখক : মাওলানা আখতারুজ্জামান খালেদ, সাবেক ইমাম ও খতীব , দুপ্তারা কুমার পাড়া জামে মসজিদ, আড়াই হাজার, নারায়ণগঞ্জ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button