ধর্ম ও জীবন

সব সৃষ্টিই আল্লাহর (তসবীহ) পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে

ঝিনাইদহের চোখঃ

“সাব্বাহা” অর্থ গুণগান করা, পবিত্রতা বর্ণনা করা, প্রশংসা করা, মহিমা ঘোষণা করা, তসবীহ পাঠ করা।
“সুবহান” অর্থ গুণগান, মহিমা, প্রশংসা, পবিত্র, মহান।

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, “আসমান সমূহে যা কিছু আছে, আর জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিপতি, অতি পবিত্র, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা জুমুআহ্- ১)

ক) অর্থাৎ বিশ্ব জাহানের প্রতিটি বস্তু সদা-সর্বদা এ শর্ত প্রকাশ ও ঘোষণা করে চলেছে যে, এই বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা ও পালনকর্তা সবরকম দোষ-ত্রুটি, অপূর্ণতা, দুর্বলতা, ভুল-ভ্রান্তি ও অকল্যান থেকে পবিত্র। তাঁর ব্যক্তি সত্তা পবিত্র, তাঁর গুনাবলী পবিত্র, তাঁর কাজ-কর্ম পবিত্র এবং তাঁর সমস্ত সৃষ্টিমূলক বা শরীয়তের বিধান সম্পর্কিত নির্দেশনাবলীও পবিত্র।

খ) যাঁর সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন পৃথিবীর কোন শক্তি রোধ করতে পারে না, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যাঁর আনুগত্য সবাইকে করতে হয়, যাঁর অমান্যকারী কোনভাবেই তাঁর পাকড়াও হতে রক্ষা পায় না, তাঁর সৃষ্টি, তাঁর ব্যবস্থাপনা, তাঁর শাসন, তাঁর আদেশ নিষেধ, তাঁর নির্দেশনা সব কিছুই জ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর। তাঁর কোন কাজেই অজ্ঞতা, বোকামি ও মূর্খতার লেশমাত্র নেই, আর তাই তিনি পরাক্রমশালী, শক্তিমান ও অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অধিকারী। (তাফসীর ইবনে কাসীর-১৭/৪১৮)

ফেরেশতাগণ তাসবীহ পাঠ করেন-

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, “যাঁরা তোমার রবের নিকট রয়েছে তাঁরা দিন-রাত তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে এবং তাঁরা ক্লান্তিবোধ করে না।” (সূরা সাজদাহ- ৩৮)

আল্লাহ তাআলা অন্যত্রে বলেন, আসমান ও জমিনে যাঁরা (ফেরেশতা) আছে তাঁরা সবাই তাঁরই মালিকানাধীন এবং তাঁর কাছে যাঁরা আছে তাঁরা অহংকারবশত তাঁর ইবাদত হতে বিমুখ হয় না এবং ক্লান্তিবোধও করে না, তাঁরা দিন-রাত পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতে থাকে, কখনও শৈখিল্য করে না। (সূরা আম্বিয়া- ১৯, ২০)

অর্থাৎ ফেরেশতাদের ইবাদতে কোন অন্তরায় নেই, তাঁরা ইবাদতে অহংকারও করে না, যে ইবাদতকে পদমর্যাদা বিপরীত মনে করবে এবং ইবাদতে কোন সময় ক্লান্তও হয় না। তাঁরা রাত-দিন তসবীহ পাঠ করে এবং কোন সময় অলসতাও করে না। যাজ্জাজ রঃ বলেন, আমাদের নিঃশ্বাস নিতে যেমন কোন কাজ বাধা হয় না তেমনি তাঁদের তসবীহ পাঠ করতে বাধা হয় না। (তাফসীর ইবনে কাসীর- ১৪/৩২১)

বজ্র আল্লাহর তসবীহ পাঠ করে-

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, আর বজ্র তাঁর প্রশংসা পাঠ করে এবং ফেরেশতারাও তাঁর ভয়ে তসবীহ পাঠ করে, আর তিনি গর্জনকারী বজ্র পাঠান। অতপর যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে আঘাত করেন এবং তারা আল্লাহ সম্বন্ধে ঝগড়া করতে থাকে, আর তিনি শক্তিতে প্রবল, শাস্তিতেও কঠোর। (সূরা রা’দ- ১৩)

ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, ইহুদীরা নবী (সা.) এর নিকট এসে বলল, হে আবুল কাসেম! আমাদেরকে রা’দ বা মেঘের গর্জন সম্পর্কে বলুন, এটা কি? তিনি বললেন মেঘমালাকে তাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ফেরেশতাদের একজন নিয়োজিত আছে। তাঁর হাতে রয়েছে আগুনের চাবুক। এর সাহায্যে সে সেই মেঘমালাকে পরিচালনা করেন, যে দিকে আল্লাহ তাআলা চান। তারা বলল, আমরা যে, শব্দ শুনতে পাই তার তাৎপর্য কি? তিনি বললেন, এটা হচ্ছে ফেরেশতাদের হাকডাক। এভাবে হাকডাক দিয়ে মেঘমালাকে তাঁর নির্দেশিত স্থানে নিয়ে যায়। আর এভাবে তাঁরা তসবীহ পাঠ করেন। তারা বলল আপনি সত্য বলেছেন। (তিরমিযী, হাঃ- ৩১১৭, সহীহ)

উড়ন্ত পাখিরাও তসবীহ পাঠ করে-

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, আপনি কি দেখেন না যে, আসমানসমূহে ও জমিনে যারা আছে এবং সারিবদ্ধভাবে উড্ডিয়মান পাখিরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করে? প্রত্যেকেই জানে তার ইবাদতের ও পবিত্রতা মহিমা ঘোষনার পদ্ধতি। আর তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত। (সূরা নূর- ৪১)

একথা বলার উদ্দেশ্য হলো এই পবিত্রতা ঘোষণার অর্থ এই যে, আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর প্রত্যেক বস্তু আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্র, উপদান চতুষ্টয়, অগ্নি, পানি, মাটি, বাতাস সবাইকে বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন সে সর্বক্ষণ সে কাজে ব্যস্ত আছে, এর চুল পরিমাণও বিরোধিতা করে না।

এই আনুগত্যকেই তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা বলা হয়েছে। যদ্ধারা সে তার স্রষ্টার ও প্রভুর পরিচয় জানতে পারে এবং তাদেরকে বিশেষ প্রকার বাকশক্তি দান করা হয়েছে ও বিশেষ প্রকার তসবীহ ও ইবাদত শিখানো হয়েছে যাতে তারা তাসবীহ পাঠে ও ইবাদতে মশগুল থাকে। কিন্তু প্রত্যেকের সালাত, তসবীহর পদ্ধতি ও আকার ভিন্নরূপ। (তাফসীর ইবনে কাসীর- ১৫/১৮৩)

পর্বতমালা, বৃক্ষলতা, জীবজন্তুও তসবীহ করে- মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, “আপনি কি দেখেন না যে, আল্লাহকে সিজদা করে যারা আছে আসমানসমূহে ও জমিনে আর সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্র মন্ডলী, পর্বতমালা, বৃক্ষলতা, জীবজন্তু এবং মানুষের মধ্যে অনেকে সিজদা করে।” (সূরা হজ- ১৮)

এর অর্থ হলো সমস্ত সৃষ্টিজগত স্রষ্টার আজ্ঞাধীন ও ইচ্ছাধীন। সৃষ্টি জগতের এই আজ্ঞানুবর্তিতা দুই প্রকার- ক) সৃষ্টি জগত ব্যবস্থাপনার অধীনে বাধ্যতামূলক আনুগত্য। মুমিন-কাফির, জীবিত-মৃত, জড় প্রদার্থ কেউ এই আনুগত্যের আওতা বর্হিভুত নয়। খ) সৃষ্টি জগতের ইচ্ছাধীন আনুগত্য। অর্থাৎ স্বইচ্ছায় আল্লাহ তাআলার বিধানাবলী মেনে চলা। আয়াতে এই প্রকার আনুগত্যই বুঝানো হয়েছে। আসমান জমিনে যতকিছু আছে সবাই আল্লাহকে সিজদা করে বা আনুগত্য করে। অনুরূপভাবে সূর্য-চন্দ্র, তারকাসমূহ, পর্বতমালা, বৃক্ষলতা ও জীবজন্তু আল্লাহর সিজদাহ ও আনুগত্য করে।

আবু যর রাঃ বলেন, আমাকে রাসূল (সাঃ) বলেন, তুমি কি জানো, সূর্য কোথায় যায়? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেন, এটা যায় আরশের নীচে, তারপর আরশের নীচে সিজদাহ করে। অতপর অনুমতি গ্রহন করে। অচিরেই এমন সময় আসবে তাকে যখন বলা হবে, যেখান থেকে এসেছ সেখানে ফিরে যাও। (সহীহ বুখারী, হা- ৩১৯৯)

তবে মানুষ ও জিন জাতীকে আল্লাহ তাআলা বিবেক ও চেতনার একটি পূর্ণস্তর দান করেছেন। মানব জাতি সর্বাধিক বিবেক ও চেতনা লাভ করেছে। এ কারণেই তাদেরকে আদেশ ও নিষেধের আওতাধীন করা হয়েছে। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যখন আদম সন্তানকে সালাতে ও কুরআনের সিজদার আয়াত পড়ে এবং সিজদাহ করে শয়তান তখন দূরে গিয়ে কাঁদতে থাকে আর বলে আদম সন্তানকে সিজদাহ করতে বলা হয়েছে সে সিজদাহ করেছে তার জন্য নির্ধারিত হলো জান্নাত। আর আমাকে সিজদাহ করতে নির্দেশ করা হয়েছিল আমি তা করতে অস্বীকার করেছি ফলে আমার জন্য নির্ধারিত হলো জাহান্নাম। (সহীহ মুসলিম, হা- ৮১, ইবনে কাসীর- ১৪/৪২৪)

লেখক : মাওলানা আখতারুজ্জামান খালেদ, সাবেক ইমাম ও খতীব, দুপ্তারা কুমার পাড়া জামে মসজিদ, আড়াই হাজার, নারায়ণগঞ্জ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button