জেনে নিন ঝিনাইদহের মরমী কবি পাগলা কানাই সম্পর্কে
আব্দুর রহমান মিল্টন, ঝিনাইদহের চোখঃ
গ্রামীন ঐতিহ্যের নানা স্টল, নাগরদোলা, লাঠিখেলা, ঝাপান খেলা, বই পাঠ, রচনা প্রতিযোগীত,লোকসঙ্গীত সহ সঙ্গীতের প্রতিযোগীতায় শিশু-কিশোর, তরুন-তরুনী আর নারী-পুরুষের ভীড়ে এখন দিন-রাত মুখোর ঝিনাইদহের বেড়বাড়ি গ্রাম । মরমী কবি পাগলা কানাই এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কবির এই জন্মভিটাতে এসব নিয়ে শুরু হয়েছে ৩দিনের মেলা । আগে যেখানে ছিল গ্রামীন মেঠো পথ এখন সেখানে কালো পিচঢালা একাধিক সড়ক ব্যবস্থা । এমন সড়ক ধরে জেলা শহর থেকে মাত্র ৪কিলোমিটার দুরে দক্ষিন-পশ্চিমদিকে বেড়বাড়ি গ্রাম। সেখানে গেলেই দেখা মিলবে কবির সমাধি, তার পাশেই একটি প্রতিকৃতি । সামনের উন্মুক্ত জায়গাতে দেখতে পাবেন অসংখ্য মানুষের ভীড় । তার আগেই কানে ভেসে আসবে ডুগি-তবলা আর একতারা দো-তারায় ধূয়াজারির সুর। ভীড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা মিলবে শিল্পীর গলায় পাগলা কানাই এর লেখা ও সুরে মানবতার গানের আসর। ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে সার্বজনীনতা লাভ করা পাগলা কানাই এর গানে বাউল আর কবিয়ালের যথার্থ মিলনও খুঁজে পাবেন ।
মেলাটির অন্যতম আকর্ষণ মরমী এই কবির স্বরোচিত প্রায় হারিয়ে যাওয়া গানের আসর । দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে এই স্বভাব কবির অমূল্য সৃষ্টির স্বাদ নিতে ভক্তবৃন্দ একদিন আগ থেকেই আসতে শুরু করে মেলা প্রাঙ্গনে । এখানে স্থানীয় শিল্পীর পাশাপাশি দেশের লোকসঙ্গীতের নামকরা সব শিল্পীরা আসেন গান পরিবেশন করতে, আসেন মরমী কবি পাগলা কানাই কে শ্রদ্ধা আর ভালবাসা জানাতে । লোকসাধনা আর মরমী সঙ্গীতের এই উর্বরভূমি পরিণত হয় এক মিলন-মেলায় ।
‘‘জিন্দাদেহে মুরদা বসন থাকতে কেন পরনা/মন তুমি মরার ভাব জাননা/ওরে মরার আগে না মরিলে পরে কিছুই হবে না ॥/আমি মরে দেখেছি, মরার বসন পরেছি /কয়েকদিন বেঁচে আছি/তোরা দেখবি যদি আয় পাগলা কানাই বলতেছি…’’ এমনি শতশত গানের রচয়িতা মরমী কবি পাগলাকানাই। আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনার সাধক অসংখ্য ধূয়াজারি, দেহতত্ত্ব, বাউল, মারফতি ও মুরশিদ গানের ¯্রষ্টা এ কবি তার অপরুপ সৃষ্টি নিয়ে গ্রাম বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরে ফিরেছেন; যা বাংলা সংস্কৃতিকে ঐতিহ্যমন্ডিত করেছে । সাধক কবির অপরিসীম এমন সব কীর্তিকে স্মরণ ও জনসমাজে বারবার তুলে ধরার জন্যে কবির জন্মবার্ষিকীতে এমন মেলা সহ নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন হয়ে থাকে ।
স্বাধীনতার আগ থেকে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালের দিকে মরমী কবি পাগলা কানাই এর জন্মভিটা ঝিনাইদহের বেড়বাড়ি গ্রামে কবির সমাধিস্থলে এ মেলা শুরু হয় । স্থানীয়দের উদ্যোগে আগে দিনব্যাপী চলত মেলা । তবে এখন এর ব্যাপ্তি বেড়েছে । সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়, জেলা প্রশাসন ও শিল্পকলা একাডেমীর সহযোগীতায় এখন চলে ৩দিনের মেলা । ২৫ফাল্গুন কবির ২০৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২৫ ফাল্গুন(৯মার্চ) থেকে শুরু হওয়া এ মেলা চলবে ২৭ফাল্গুন(১১মাচর্) পর্যন্ত । কবির সমাধির পাশাপাশি এখানে কবির প্রতিকৃতি, অডিটোরিয়াম, গণপাঠাগার, সঙ্গীতএকাডমী ও কবির স্মরণে একটি স্মৃতি সংসদও রয়েছে ।
এখানে বেড়াতে বা মেলাতে আসলে এলাকার বয়স্ক মানুষের মুখে জানতে পারবেন তাদের পূর্বপুরুষরা কেমন দেখেছে কবিকে, কেমন ছিল তার জীবনাচার । পাগলা কানাই এর পঞ্চম পুরুষরা এখনো রয়েছে সেই বসতভিটা ও গ্রামটিতে । অনেকের মতে ছোটবেলা থেকেই সাধক এ কবি দূরন্ত ও আধ্যাত্মিক স্বভাবের ছিলেন। বাল্যকালে পিতৃহারা পাগলা কানাই-এর ঘরে মন না টেকায় অর্থের অভাবে পড়ালেখা হয়নি। তিনি মানুষের বাড়ি রাখালের কাজ করেছেন। গরু চরাতে গিয়ে ধুয়ো জারি গান গাইতেন। নিরক্ষর হলেও তার স্মৃতি, মেধা ছিল প্রখর। তিনি উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গান রচনা করে নিজ কন্ঠে পরিবেশন করতেন। পাগলাকানাই-এর অসংখ্য গান গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে।
মরমী কবি পাগলা কানাই বাংলা ১২২৬ সালের ২৫ ফাল্গুন জন্মগ্রহণ করেন আর মৃত্যুবরণ করেন ১২৯৬ সালের ২৮ আষাড় ।
যেভাবে আসবেন-
ঢাকা থেকে ঝিনাইদহের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার আর গন্তব্য পর্যন্ত অর্থাৎ বেড়বাড়ি গ্রামে পৌঁছাতে আর ৪ কিলোমিটার যেতে হয়। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রতিদিন ঝিনাইদহর উদ্দেশে বেশ কিছু এসি, ননএসি পরিবহন ছেড়ে আসে। আবার ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ফিরে যায়। এসব পরিবহনের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স, রয়েল পরিবহন, জে আর পরিবহন, পূর্বাশা, মেহেরপুর ডিলাক্স, দর্শনা ডিলাক্স, ঝিনাইদহ লাইন অন্যতম। এ ছাড়া আরো ২০/২৫ ধরনের দূরপাল্লার পরিবহন নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। সাড়ে ৪শ থেকে ৫’শ (নন এসি) আর ৮’শ থেকে হাজার টাকার মধ্যে এসি বাসে যাতায়ত করতে পারেন ।
পূর্বাশা পরিবহনের এসি গাড়িগুলো প্রতিদিন ঢাকার মাজার রোড ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল সাড়ে ৯টায়, সাড়ে ১১টায়, দুপুর পৌনে ১টা, বিকেল ৩টা ৪৫, ৪টা ৪৫, রাত ৮টা ৩০ ও রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে ছেড়ে আসে।
পাঁচ ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে ঢাকা থেকে ঝিনাইদহ পৌঁছে যায় এসব পরিবহন, তবে দৌলদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে কখনো কখনো জ্যামে আটকে পড়লে আরো দেড় ঘণ্টা বেশি সময় লাগে। ফেরী পারাপার বাদেও বাসে চেপে ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ- যমুনা সেতু হয়ে কুষ্টিয়া এরপর ঝিনাইদহে আসা যায় ।
যেখানে থাকবেন-
ঝিনাইদহ জেলা শহর থেকে মাত্র ৪কিলোমিটার দূরে বেড়বাড়ি গ্রামে কবি পাগলা কানাই এর মেলাতে বা বেড়াতে এসে আপনি থাকতে পারবেন জেলা শহরে । সরকারী বেশকিছু রেস্টহাউজ রয়েছে । এছাড়া মানসম্পন্ন আবাসিক হোটেল, রেস্তরা রয়েছে ।